রবিবার, ২০ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

কাঁদতে ভুলে গেছে সেন্ট্রাল আফ্রিকার মানুষ

শিমুল মাহমুদ, সেন্ট্রাল আফ্রিকা থেকে

কাঁদতে ভুলে গেছে সেন্ট্রাল আফ্রিকার মানুষ

সেন্ট্রাল আফ্রিকার রাজধানী বাঙ্গির একটি স্কুলের ক্লাসরুম —বাংলাদেশ প্রতিদিন

ক্যামেরায় ছবি তুলতে গেলে মারমুখী হয়ে তেড়ে আসে তারা। নিজেদের হতশ্রী দৈন্যতাকে বাইরে প্রকাশ হতে দিতে চায় না মোটেও। কিন্তু নৃশংসতায়, ঠকবাজিতে চূড়ান্ত পারদর্শী। অপেক্ষাকৃত অলস এই মানুষগুলোর নিজেদের ভাগ্যবদলের কোনো তৎপরতা নেই। দারিদ্র্য আর কষ্টের জীবন টেনে কাঁদতেও ভুলে গেছে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের মানুষ। পথে-ঘাটে, ঘরে-বাইরে কোথাও কান্নার শব্দ শোনা যায় না। হাসি তো আরও পরের বিষয়। জাতিগত সংঘাতে উন্মাতাল খ্রিস্টান ও মুসলমানদের দুটি সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যদের হাতে হাতে অস্ত্র। মুসলমানদের গ্রুপটির নাম এক্স সেলেকা আর খ্রিস্টানদের গ্রুপটির নাম এন্টি বালাকা। কে কাকে কতটা নৃশংসভাবে মারতে পারে তার ওপরই নির্ভর করে সে কত বড় নেতা। কথায় কথায় তীব্র হানাহানিতে লিপ্ত হতে সময় লাগে না তাদের। এমনকি শিশুরা ফুটবল খেলা নিয়ে ঝগড়া লাগলেও ঘর থেকে গ্রেনেড নিয়ে আসে। গত ৩০ বছর ধরে জাতিসংঘ এখানে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করছে। কিন্তু শিক্ষার আলোহীন এই মানুষগুলোর কোনো পরিবর্তন আসেনি। মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মধ্যে হানাহানি নৈমিত্তিক ব্যাপার। দেশটিতে সংখ্যালঘু হলেও ২০১৩ সালে সেলেকা নামে মুসলিম বিদ্রোহীদের কয়েকটি গ্রুপ ক্ষমতা দখল করে। ফলে ফ্রান্সের কাছ থেকে ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে যে অস্থিরতা চলছিল তা রূপ নেয় সংঘাতে। মুসলমানরা সংখ্যায় মাত্র ১০ শতাংশ হলেও অস্ত্রের জোগান ও ক্ষমতায় যথেষ্ট শক্তিশালী। সেন্ট্রাল আফ্রিকার উত্তর সীমান্তে শাদ, উত্তর-পূর্বে সুদান, পূর্ব-দক্ষিণে সুদান, দক্ষিণে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো ও কঙ্গো প্রজাতন্ত্র এবং পশ্চিমে ক্যামেরুন। মুসলমানদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করছে সুদান ও ক্যামেরুন। মুসলমানদের সেলেকার মোকাবিলায় অ্যান্টি বালাকা নামে একটি খ্রিস্টান জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক চাপে ২০১৪ সালে সেলেকা একটি অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেও মাসের পর মাস সংঘাত চলতেই থাকে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী ও ফরাসি মিশনের উপস্থিতির পরও দেশটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

দেশটি হীরা, সোনা, তেল, ইউরেনিয়ামের মতো খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ এটি। নিজেদের এসব উত্তোলনের সক্ষমতা ও প্রযুক্তি নেই। ফ্রান্সসহ অন্যরা বিভিন্ন স্বার্থ নিয়ে কাজ করছে দেশটিতে। রাজধানী বাঙ্গি থেকে একমাত্র সড়ক ধরে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার ঘুরেও কোনো দোতলা বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়নি। রাজধানী থেকে ক্যামেরুন সীমান্ত পর্যন্ত ৬১০ কিলোমিটার সড়কটি নির্মাণ করেছে চাইনিজ একটি কোম্পানি। ২০১৩ সালের দিকে সেই চাইনিজ কোম্পানির কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ারকে মেরে ফেলায় তাদের বাকি সদস্যরা সড়কের নির্মাণ কাজ ফেলে পালিয়ে যায়। সেই থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার রাস্তা কাঁচা রয়ে গেছে। পশুপাখি, জন্তু-জানোয়ার তাদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার। তাদের বাজারগুলোতে জীবন্ত পোকামাকড়, ফ্রাই করা পাখি, ইঁদুর, বানর বিক্রির উদ্দেশ্যে সাজিয়ে রাখতে দেখা গেল। কিন্তু নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে গাড়ি থেকে বাজারে নেমে এসব প্রত্যক্ষ করা গেল না। গত মঙ্গলবার গাড়ি থেকে ছবি তোলার কারণে ক্যামেরা দেখে ক্ষিপ্ত লোকজন দুই দফা ঢিল ছুড়ে মেরেছে। দেশ ঘুরে বয়স্ক মানুষের দেখা পাওয়া গেল না কোথাও। অপুষ্টি, রোগ জর্জরিত দেশটির যুবকদের বড় অংশই মারা গেছে জাতিগত সংঘাতে। খুনোখুনি তাদের রক্তে মিশে আছে। নৃশংসতা তাদের অস্তিমজ্জায়। হাসি-কান্নার আবেগ স্বাভাবিক কারণেই অনুপস্থিত তাদের আচরণে। সেন্ট্রাল আফ্রিকার একটি বড় অংশ এমনকি রাজধানী ঘুরেও কোথাও বাস সার্ভিস দেখা গেল না। গণপরিবহন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে জিপ। মোটরসাইকেল জনপ্রিয় বাহন। এক মোটরসাইকেলে কমপক্ষে তিনজন যাত্রী ছাড়াও হাঁস, মুরগি, ছাগল গাদাগাদি করে পরিবহন করে। সশস্ত্র গ্রুপগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও দেশটির সাধারণ মানুষের আস্থায় রয়েছে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা। তারা অপারেশনাল কার্যক্রমের পাশাপাশি সিভিল মিলিটারি কো-অপারেশনের (সিমিক) আওতায় স্থানীয় মানুষদের নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বৃহস্পতিবার স্থানীয় একটি স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলটির আসবাবপত্র, রুমসহ শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের পক্ষ থেকে। আমাদের দেখে স্কুলের ছোট শিশুরা ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল। হাজার হাজার মাইল দূরে সভ্যতার আলোবঞ্চিত মানুষগুলোর মুখে নিজের দেশের নাম শুনে বুকটা ভরে গেল।

সর্বশেষ খবর