রবিবার, ২৭ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

হুন্ডিতে হয় যত সর্বনাশ

১০ বছরে পাচার ৬ লাখ কোটি টাকা, অভিযান হবে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে

জুলকার নাইন

হুন্ডিতে হয় যত সর্বনাশ

এবার অ্যাকশন নেওয়া হবে ভয়াবহ হুন্ডি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের রয়েছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেশ থেকে প্রতিবছর টাকা পাচার হচ্ছে। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও গড়ে উঠেছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে এই চক্র তা বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। এর মধ্যে বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির মাধ্যমে টাকা পাচারের অনেক ঘটনা ধরা পড়েছে ইতিমধ্যে।

বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয় দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং ও থাইল্যান্ডে। এর বাইরে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম নিয়ে অনেক দিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে। সরকারের একাধিক সংস্থা এ নিয়ে তদন্তও করেছে। পানামা কেলেঙ্কারির পর সংশ্লিষ্ট অনেককে দুর্নীতি দমন কমিশন জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। হুন্ডি সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। তারা মনে করে, হুন্ডির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা পাচারের সিন্ডিকেট বন্ধ করা গেলে ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে। সূত্রমতে, হুন্ডি ও অর্থ পাচারের মতো অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। বিভিন্ন জেলার ৬৩২ জনের নামের তালিকা-সংবলিত

বিশেষ প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠায় গোয়েন্দা সংস্থাটি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তা স্বরাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এ ব্যাপারে অধিকতর তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশের পৃথক তিনটি ইউনিট এবং অর্থ মন্ত্রণালয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশ দিয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী সংস্থাগুলো তদন্তও শুরু করেছে বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে হুন্ডি ব্যবসা প্রতিরোধে পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, র‌্যাব, বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে সীমান্তবর্তী এলাকায় অভিযান পরিচালনা। স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের সক্রিয়তা আরও বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে সুপারিশে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশের বৈধ চ্যানেলে স্বল্প খরচে ও দ্রুততম সময়ে টাকা পাঠানোর নিশ্চয়তা বিধান করার পাশাপাশি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে হুন্ডির মাধ্যমে মুদ্রা পাচারের সম্ভাব্য সহায়তাকারী সন্দেহজনক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড নজরদারিতে আনার। সেই সঙ্গে অনুমোদনবিহীন মুদ্রাবিনিময় ব্যবসায়ীদের কাছে জনগণ যাতে না যায়, সে ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রচারণার ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক অর্থ পাচারবিরোধী সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, শুধু ২০১৪ সালেই বাংলাদেশ থেকে আরও প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। ২০১৩ সালে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা। এভাবে গত ১০ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে ছয় লাখ ছয় হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত জিএফআই প্রতিবেদনে সর্বোচ্চ অর্থ পাচারের দিক থেকে বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৬তম।

জানা যায়, অর্থ পাচারের প্রধান মাধ্যম এখন হুন্ডি। মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীরাও বিদেশে অর্থ পাচার করে বাড়ি বানাচ্ছেন, জমি কিনছেন, কারখানা গড়ছেন। ব্যবসায়ীরা দেদার অর্থ পাচার করছেন আমদানি-রপ্তানির আড়ালে; আমদানি পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে আর রপ্তানি পণ্যের দাম কম দেখিয়ে। এজেন্টের কাছে রেমিট্যান্সের অর্থ জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আত্মীয়স্বজনের ঠিকানায় রেমিট্যান্সের টাকা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। জিএফআই জানায়, সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে হুন্ডিচক্র এতটাই সক্রিয় হয়ে উঠেছে যে, ব্যাংকিং বা অন্য যে কোনো মাধ্যমের চেয়ে অত্যন্ত দ্রুত এবং কোনো রকম হয়রানি ছাড়াই তারা গ্রাহকের ঠিকানায় টাকা পৌঁছে দিচ্ছে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান বলেন, হুন্ডি টাকা পাচারের একটি ভয়ঙ্কর মাধ্যম। কেননা আমদানি বা রপ্তানির মাধ্যমে টাকা পাচার করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ডকুমেন্ট বা কাগজপত্র প্রদর্শন করতে হয়। এর ফলে অপরাধীর পরিচয় একসময় পাওয়া যায়। কিন্তু হুন্ডিতে মূলত এজেন্টের মাধ্যমে টাকা লেনদেন হয়। এটি পুরোপুরি চলে বিশ্বাসের ওপর। এখানে কোনো কাগজপত্রের লেনদেন হয় না। এ প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার করা হলে পাচারকারীদের শনাক্ত করা খুবই কঠিন। এ ছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে টাকা স্থানান্তরে খরচ কম। এ কারণেই পাচারকারীরা হুন্ডিকেই পছন্দ করে বেশি। শুধু বাংলাদেশ থেকে টাকা যায় না, টাকা আসেও হুন্ডির মাধ্যমে। বৈধ পথে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা থাকার কারণে প্রবাসী শ্রমিকরাও হুন্ডির আশ্রয় নিয়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক জরিপে দেখা যায়, প্রবাসীরা বিদেশ থেকে দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠান, ৪০ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। ৩০ শতাংশ আসে সরাসরি প্রবাসী বা তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে নগদ আকারে এবং বাকি ৩০ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে মোট দেড় হাজার কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। হিসাব অনুযায়ী এর মধ্যে হুন্ডির মাধ্যমে এসেছে প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে দেশ থেকে বৈদেশিক সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে। কাতারে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশি সুমন টেলিফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা জমা দিতে নানা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। ব্যাংকে পাসপোর্ট নিয়ে যেতে হয়। নাম লিখতে হয়। লাইন ধরতে হয়। এর চেয়ে পরিচিত লোকের মাধ্যমে (হুন্ডিতে) টাকা পাঠানোই ভালো। এ ছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালে এক রিয়ালের দাম পাওয়া যাচ্ছে ২২ টাকা ১৭ পয়সা। অথচ হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে এক রিয়ালের দাম পাওয়া যাচ্ছে ২২ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৫০ পয়সা। এখন হুন্ডির তুলনায় প্রতি এক হাজার রিয়ালে ব্যাংক ট্রান্সফার করলে ৪০ থেকে ৫০ রিয়াল কম পাওয়া যায়। এর মধ্যে সার্ভিস চার্জ রয়েছে। তাহলে কষ্টের টাকা শ্রমিকরা লস করতে চাইবে কেন!’ বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে ডলারের বাজার স্বাভাবিক থাকবে। গত দুই বছরে ডলারের বাজার বারবার অস্থিতিশীল হয়েছে। সরকারের প্রথম সাত বছর টানা ডলারের মূল্য একই রকম থাকলেও এখন আর তা নেই। এই না থাকার কারণ হুন্ডি।  এ কারণে হুন্ডি বন্ধ করা জরুরিভাবে দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি জানিয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর