বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভুয়া ঋণে সর্বনাশ

এক ব্যাংকের পরিচালক গোপনে ঋণ নিচ্ছেন অন্য ব্যাংক থেকে

আলী রিয়াজ

জামানত ছাড়া ঋণে সর্বনাশ হচ্ছে ব্যাংক খাতের। দীর্ঘদিন ধরে দেশের ব্যাংক খাতে জামানতবিহীন ঋণের একটি অপসংস্কৃতি চলছে। ব্যাংক লুটপাটের এক অভিনব পদ্ধতি কর্পোরেট ঋণের নামে দেওয়া হচ্ছে এসব জামানতবিহীন ঋণ। নতুন নামে আরজেএসসি থেকে ২/৩টি কোম্পানির অনুমোদন নিয়ে নামসর্বস্ব গ্রুপ অব কোম্পানিজ খুলে করপোরেট ঋণ নেওয়া হচ্ছে ব্যাংক থেকে। শুধু তাই নয় ব্যাংক থেকে করপোরেট ঋণের নামে এক ব্যাংকের পরিচালক আরেক ব্যাংক পরিচালককে কোটি কোটি টাকার ঋণ দিয়ে দিচ্ছেন কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই। পরবর্তীতে এসব ঋণের এক টাকাও ফেরত আসছে না ব্যাংকে। এমন কি এসব ঋণের মোটা অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচারও করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবেও এই জানামতবিহীন ঋণ দেওয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ জন্য কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই ছাড়া ব্যাংক ঋণ দেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, মর্টগেজ হিসেবে ভুয়া কাগজপত্র জমা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ব্যাংক থেকে। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন জামানত নেওয়া কাগজপত্রের বিপরীতে থাকা জমিজমা বা ভবনে ঋণদাতা ব্যাংকের সাইনবোর্ড দেওয়া বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংকের জালিয়াতি থামাতে হলে ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের বিকল্প নেই। কীভাবে একটি দলিলের বিপরীতে একাধিক ব্যাংক ঋণ দিয়ে থাকে তা খতিয়ে দেখা দরকার। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে যে জমির বিপরীতে ঋণ নেওয়া হয় সেখানে ব্যাংকের সাইনবোর্ড থাকা উচিত। এটা সব ক্ষেত্রে মানা হয় না। এই চর্চাটা বাধ্যতামূলক করা দরকার। তবে সবার আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। নইলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে নেওয়া এমন জামানতবিহীন কয়েক হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। জমি, মর্টগেজের ভুয়া দলিল, বা স্থাবর সম্পত্তির ভুয়া কাগজপত্রের কোনো যাচাই-ছাড়াই শত শত কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে করপোরেট ঋণের নামে। ঋণ নেওয়ার পর আর খুুঁজে পাওয়া যায় না গ্রহীতাকে। এর ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতি মাসে। গত তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। ফলে ব্যাংক খাতে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার কোটি টাকা। যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। ব্যাংকগুলোতে বিভিন্ন সংকটের অন্যতম কারণ জামানতবিহীন ঋণ। এতে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট তৈরি হচ্ছে। ঋণ নিয়েই অনেকে পাচার করেও দিচ্ছেন বিদেশে। জানা গেছে, ব্যাংকের পরিচালকরা প্রভাব খাটিয়ে নিজের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে না পারেন সে জন্য নিজ ব্যাংক থেকে পরিচালকদের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ সীমিত করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে কোনো কাজ হয়নি। বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালকরা ঋণের সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালক ধরে সেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। আবার নিজের ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের পরিচালককেও ঋণ পাইয়ে দিচ্ছেন। এভাবে পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিলেও এর বিপরীতে তেমন কোনো জামানত রাখতে হচ্ছে না। তুলনামূলক কম সুদে ঋণ নিয়েও পরে ওই টাকা পরিশোধ না করায় ওই ঋণ আদায় করতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জামানতবিহীন ঋণ আদায় করাও সম্ভব হচ্ছে না। দেখা গেছে, বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের বেশিরভাগই ব্যবসায়ী। তাঁদের ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যাংকের পরিচালক হওয়ায় অনায়াসে এসব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে বড় অঙ্কের ঋণ নিতে পারছেন তাঁরা। তাছাড়া সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তাঁরা অন্যান্য সাধারণ ঋণগ্রহীতার চেয়ে সস্তায় ঋণ পাচ্ছেন। এত সুবিধা পাওয়ার পরও অনেক পরিচালক ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে নামি-বেনামি ঋণের এক অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে। পাশাপাশি জামানতবিহীন মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এতে ব্যাংকগুলো তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেই। যার প্রভাব পড়ছে সামষ্টিক অর্থনীতিতে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শনে দেখা গেছে, ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে রেজিস্ট্রেশন অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ (আরজেএসসি) থেকে অনুমোদন নেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের। এমন ২ থেকে ৩টি কোম্পানির কাগজপত্র তৈরি করে করপোরেট প্রতিষ্ঠান গঠন করেই ব্যাংকে ঋণ আবেদন করেন। দ্রুততার সঙ্গে অনুমোদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যাচাই প্রতিবেদন সংযুক্ত করে জমা দেওয়া হয় ব্যাংকে। সরাসরি যাচাই না করেই ঋণ সিন্ডিকেটের ব্যক্তিরা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে প্রতিবেদন দেয়। এই সিন্ডিকেটে জড়ানো হয় ব্যাংকের কর্মকর্তা, ভূমি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব প্রতিবেদন পুরোপুরি মিথ্যা। ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা কোনো ধরনের যাচাই না করেই ব্যাংকের হাতে প্রতিবেদন জমা দেন। অনেক সময় দেখা যায় আবেদনের এক মাসের মধ্যেই ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়ে যায় এসব ভুয়া করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই অর্থাৎ ব্যাংকে কোনো ধরনের অর্থ না থাকার পরেও ঋণ দিয়ে দেওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে এসব জামানতবিহীন ঋণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর