শুক্রবার, ৮ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

স্বস্তির মাঝে আছে শঙ্কাও

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

প্রস্তাবিত বাজেট গতানুগতিক। বরাদ্দ বৃদ্ধি ছাড়া বাজেটে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। নির্বাচনী বছরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বাজেটে বড় পরিবর্তন আনতে চাননি। বরং করপোরেট করহার কমিয়ে, কিছু ক্ষেত্রে দেশি শিল্পে প্রণোদনা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাত বাড়িয়ে সবাইকে খুশি করার প্রচেষ্টায় বেশ স্বস্তির সঙ্গেই নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করলেন অর্থমন্ত্রী। তবে স্বস্তির সঙ্গে এ বাজেটে রয়েছে ঝুঁকি ও শঙ্কা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নতুন যে বাজেট ঘোষণা করা হলো, এটি বাস্তবায়ন হবে এমন এক সময়ে যখন চারদিকে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সব দলকে নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপ রয়েছে সরকারের ওপর। নির্বাচন কমিশনও সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো কারণে এ লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত হলে অথবা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মতৈক্য না হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন পড়বে ঝুঁকির মুখে। আর এই রাজনৈতিক ঝুঁকি কেবল বাজেট বাস্তবায়নকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে তাই নয়, বাজেটের ঘোষণা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয়, বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি অর্জন— সবকিছুতেই ঝুঁকি সৃষ্টি হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) উৎস থেকে প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আয় করতে হবে। চলতি অর্থবছরে এনবিআর কর রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। আগের অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্বের টার্গেট পূরণ করতে হলে এনবিআরের প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ বাড়িয়ে প্রায় ৩০ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। নির্বাচনী বছরের বাজেটে এটা এক ধরনের অসম্ভব লক্ষ্য বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আয়ে আশা দেখছেন নতুন তরুণ করদাতাদের ওপর নির্ভর করে। বাজেট ঘোষণায় তিনি নিজেই (টেবিল চাপড়ে) বলেছেন, আমি আশা করেছিলাম, আমাদের টিআইএন নম্বরধারী করদাতার সংখ্যা ১৫ লাখে উন্নীত করব। খুশির কথা এটা এখন ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে। অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি যে, দেশে করদান-প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী, বিশেষ করে যুব সম্প্রদায় স্বঃতস্ফূর্তভাবে আয়কর প্রদান করছে।’ বিশেজ্ঞদের মতে নতুন করে টিআইএনধারী করদাতার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারি কর্মকর্তা ও তরুণ করদাতা। সংখ্যায় বেশি হলেও টাকার অঙ্কে এদের কর প্রদানের হার খুব বেশি নয়। ফলে নতুন এই তরুণ করদাতাদের ওপর নির্ভর করে রাজস্ব আয়ের যে টার্গেট দেওয়া হয়েছে তা ঝুঁকিপূর্ণ। বাজেটের আরেক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো। বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রশ্নটিও। কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হলে বাজেটে ঘোষিত ৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন ঝুঁকিতে পড়বে। সরকারের মেয়াদের শেষ ও প্রথম বছরে উদ্যোক্তারা নানা ধরনের অনিশ্চয়তায় ভোগেন। তারা নতুন কোনো বিনিয়োগে আসতে চান না। সে অর্থে নির্বাচনী বছরের এ বাজেটে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির যে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী সেখানেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে বিনিয়োগের বিষয়টি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দিয়ে যে বিনিয়োগ টানা সম্ভব নয় তা চলতি বছরেই প্রমাণিত হয়েছে। সরকার অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বিভিন্ন অবকাঠামো সুবিধা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে একাধিক অগ্রাধিকার প্রকল্পও রয়েছে। পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ১০০ অর্থনৈতিক জোন স্থাপনের। তবে এগুলোর সুফল মিলতে সময় লাগবে। পাশাপাশি যোগাযোগ অবকাঠামো খাতেও বিস্তর উন্নতি করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গতি আনতে হলে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। গুরুত্ব দিতে হবে ঢাকার সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থার ওপরও। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে চার লেন করা হলেও যানজটের কারণে এর সুফল পাচ্ছেন না শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। এটিকে এখন আট লেনে উন্নীত করার দাবি উঠছে। এর পরের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাস্তবায়ন দক্ষতা বাড়িয়ে উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো শেষ করা এবং সরকারি বিনিয়োগের গুণগত মান নিশ্চিত করা। এ বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। তবে সুফল মিলছে না খুব একটা। বিশেষত বিদেশি অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলোর ঢিলেমি রয়েছে। নির্বাচনী বাজেটে দৃশ্যমান উন্নয়ন জনগণের নজরে আনার জন্য মেগা প্রকল্পগুলোয় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের গুণগত মান বজায় রেখে এ বরাদ্দ সঠিকভাবে ব্যবহার করা নিয়েও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবায়ন ক্ষমতা নিয়ে বড় সংশয় রয়েছে। যে মেগা প্রকল্পগুলোর কথা বলা হচ্ছে, সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন করতে না পারায় তার সুফল থেকে জাতি বঞ্চিত হচ্ছে তা-ই নয়, এগুলো বাস্তবায়নে ব্যয়ও বাড়ছে। ফলে সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি দায় সৃষ্টি হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তেমন কোনো দিকনির্দেশনাও নেই বাজেটে। সর্বশেষ ঝুঁকি হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে। সাম্প্রতিক গতিধারায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি স্বস্তিদায়ক অবস্থানে ফিরে এসেছে। তবে নির্বাচনের বছরে অর্থ পাচারের শঙ্কা ও বাজারে ডলার সংকট নতুন ঝুঁকি তৈরি করেছে। এর ওপর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি বাজেটে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করতে পারে। বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দামও। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বিশ্ববাজারের এ পরিস্থিতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী নিজেও শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। তিনি বাজেটে বলেছেন, ‘স্বস্তির সঙ্গে কিছুটা শঙ্কাও যুক্ত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ বাড়েনি তাল মিলিয়ে। ফলে ২০১৮ সালে অপরিশোধিত তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৬৫ মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে, ২০১৭ সালে যা ছিল ব্যারেলপ্রতি ৫৩ মার্কিন ডলার। তদুপরি তিন বছর ক্রমাগত স্থির থাকার পর কৃষিপণ্যের মূল্য ২০১৮ সালে ২ শতাংশ এবং ধাতব পণ্যের মূল্য ৯ শতাংশ বাড়বে মর্মে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ভারত, চীনসহ প্রতিবেশী দেশসমূহেও মূল্যস্ফীতির গতিধারা ঊর্ধ্বমুখী।’ অর্থমন্ত্রীর এই শঙ্কার বাস্তব প্রতিফলন ঘটলে বাজেটের আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য ঝুঁকিতে পড়বে।

সর্বশেষ খবর