শনিবার, ৯ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

ধনাত্মক-ঋণাত্মক অর্থে এই বাজেট ব্যতিক্রমী

মাহমুদ আজহার

ধনাত্মক-ঋণাত্মক অর্থে এই বাজেট ব্যতিক্রমী

ড. আকবর আলি খান

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, ‘২০১৮-২০১৯ সালের প্রস্তাবিত বাজেট ধনাত্মক ও ঋণাত্মক অর্থে একটি ব্যতিক্রম ধর্মী বাজেট। ধনাত্মক অর্থে ব্যতিক্রম এই জন্য বাজেটের বিপুল আয়তন প্রায় ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা এর আগে কখনই হয়নি। এর আরও ধনাত্মক দিক হলো গত বছর এর প্রবৃদ্ধির হার মোটামুটি সন্তোষজনক ছিল। মূল্যস্ফীতির হার মোটামুটি কম ছিল। প্রশ্ন হলো এত বড় বাজেট থেকে কী লাভ হবে?’

গতকাল সকালে গুলশানে নিজ বাসভবনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ প্রশ্ন তুলেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ। এ সময় তিনি সংসদে প্রস্তাবিত সদ্য ঘোষিত বাজেটের সামগ্রিক দিক নিয়ে কথা বলেন।

সাবেক এই অর্থসচিব বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী অবশ্যই নির্বাচনকে সামনে রেখে বাজেট প্রণয়ন করেছেন। যদি তিনটি অনুমান সত্য হয়, তাহলে বাজেট থেকে কিছু ফল পাওয়া যেতে পারে। একটি হলো দেশে সুশাসন থাকতে হবে। দুই নম্বর হলো, যে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলোর সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে, যাতে সঠিক বিনিয়োগ হয়। তিন নম্বর হলো, সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হতে হবে। কিন্তু এ অনুমানগুলোর যুক্তিসঙ্গত কোনো ভিত্তি দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে বর্তমানে অনেক সমস্যা রয়েছে।’

আকবর আলি খান বলেন, ‘অন্যদিকে যদি আমরা ঋণাত্মক দিকগুলো দেখি, এ সংসদে বাজেটের আদৌ কোনো ভূমিকা থাকবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। প্রথমত, এখন যে বিরোধী দল আছে তা সরকারের কনিষ্ঠ অংশীদার। এদের ঠিক চিরাচরিত বিরোধী দল বলা যায় না। বিরোধী দল ছাড়া সংসদে অর্থবহ আলোচনা কিংবা সমালোচনা হবে না। দ্বিতীয়ত সমস্যা হলো, বাজেট পেশ করা হয়েছে ৭ জুন। ৩০ জুনের মধ্যে এটা পাস করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে ঈদের বন্ধ। যে কাগজপত্রগুলো দিয়েছে এগুলো কেউ পড়তে পারবে বলে মনে হয় না। সুতরাং সংসদের কোনো অর্থবহ ভূমিকা থাকবে না। এটা মূলত নির্বাহী বিভাগের বাজেট।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাহী বিভাগের বাজেটে আমাদের সমস্যাগুলো খেয়াল রাখতে হবে, দেশে যদি সুশাসন না থাকে তাহলে দেখা যাবে যতই ব্যয় করা হোক না কেন এর ফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় না। দুই নম্বর যে সমস্যা তা হলো, এখন যেভাবে দেশ পরিচালিত হচ্ছে তাতে সম্পদের প্রচুর অপচয় হচ্ছে। গত ১০ বছরে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা যেমন রেলওয়ে, বিভিন্ন সরকারি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং ব্যাংকগুলো মিলে অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। এগুলো দিয়ে চার-৫টা পদ্মা সেতু অনায়াসে নির্মাণ করা যেত। সুতরাং এই যে দেশের সম্পদ অপচয় হচ্ছে এটা রোধ করার জন্য অর্থমন্ত্রী গত ১০ বছরে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।’

আকবর আলি খান বলেন, ‘তিন নম্বর সমস্যা হলো, আমাদের দায়ের পরিমাণ ক্রমে বেড়েই চলছে। বর্তমান বছরের উন্নয়ন বাজেট হলো ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। আর আমাদের বাজেট ঘাটতি হলো ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ৮৭ ভাগ উন্নয়ন ব্যয় আসবে বাজেট ঘাটতি থেকে। আমাদের যে এ বছরই বাজেট বড় তাই নয়, গত ৫ বছর ধরেই এ ধরনের বাজেট দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে সরকারের যে ঘাটতি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানে এক পর্যায়ে এমন হয়েছিল, যে ঘাটতির ফলে তাদের রাজস্ব বাজেটের ব্যয় ধার না করে খরচ করতে পারছে না। আমাদেরও সেই পরিস্থিতির দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের রাজস্ব বাজেটের ব্যয় অত্যন্ত বেড়ে গেছে।’

সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে কিন্তু উৎপাদনশীলতা বাড়ানো হয়নি। এর ফলে রাজস্ব বাজেটের যে ব্যয় সেটা মেটানোর পর উন্নয়নের জন্য কোনো ব্যয় থাকবে কি না সন্দেহ আছে। সবশেষে আমাদের উন্নয়ন ব্যয় অবকাঠামো ঘাটতি পূরণের জন্য অনেক বড় প্রকল্প গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেই প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে নির্বাচন করা হয় কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বড় প্রকল্পের একটা বড় সমস্যা হলো সুশাসন না থাকলে সেখানে দুর্নীতির সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়, অর্থের অপচয় হয়। সামগ্রিকভাবে যদি আমরা সঠিকভাবে  অর্থনীতি পরিচালনা করতে চাই তাহলে সতর্ক হতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আনন্দের কথা আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের দেশে পরিণত হওয়া শুধু আনন্দের ব্যাপার নয়, এখানে দায়িত্বেরও ব্যাপার রয়েছে। তার কারণ হলো অনেক সময় সুযোগ-সুবিধা কমে যাবে। শুধু তাই নয়. এর সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যেসব দেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে তাদের প্রবৃদ্ধির হারও কমে যাবে। সুতরাং আমাদের প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমার সম্ভাবনাও রয়েছে। এই অবস্থাতে অর্থনীতিকে আরও সুচারুরূপে পরিচালনা করতে হবে। এটা যদি না হয় তাহলে ব্যতিক্রমধর্মী যে বাজেট তা নির্বাচনের একটা স্লোগান হিসেবেই থাকবে, এর বেশি কিছু হবে বলে মনে হয় না।’

এ বাজেটে ধনীদের তুষ্ট ও দরিদ্রদের আরও দরিদ্র করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে আকবর আলি খান বলেন, ‘এটা ব্যতিক্রমী কোনো বাজেট নয়। গত ১০ বছর ধরে এই ধারাবাহিকতাই চলে আসছে। মূলত এখানে নতুন কর আরোপ করা হয়নি। তবে অবশ্যই ধনীদের সুযোগ বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে যারা ব্যাংক, বীমা করার লাইসেন্স পেয়েছেন তাদেরই কর হার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের কোনো ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমাদের দেশে এখনো বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ এ বাজেটে দেখছি না।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজস্ব বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন সুবিধা, বেতন বৃদ্ধি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে ব্যয়ের পরিমাণ বিরাট অঙ্কে বেড়ে গেছে। ব্যয়ের পরিমাণ বাড়াতে হলে সরকারি কর্মচারীদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। এটার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সুতরাং এটা থেকে মনে হয় সরকার শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তুষ্টই করতে চান, কিন্তু তাদের থেকে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে কোনো উদ্যোগ নিতে চান না।’

সর্বশেষ খবর