সোমবার, ১১ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

খালেদাকে নেওয়া হচ্ছে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে

জামিন আবেদনের শুনানি মুলতবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

শেষ পর্যন্ত গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) আনা হয়নি কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে। সরকার চায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেলেই চিকিৎসা হোক বেগম জিয়ার। এ নিয়ে সরকারের দুজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী কথাও বলেন। তবে বিএনপি চায় তাদের নেত্রীর চিকিৎসা হোক রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে। গতকাল কারা কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নিয়ে আসতে চাইলে বেগম জিয়ার অনিচ্ছায় শেষ পর্যন্ত তাকে হাসপাতালে আনা সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে। আজ আবারও বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে আনার চেষ্টা করা হবে বলে কারা সূত্রে জানা গেছে। শনিবার খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চার চিকিৎসক তাঁকে কারাগারে গিয়ে দেখে আসেন। পরে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, গত মঙ্গলবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘মাইল্ড স্ট্রোক’ হয়েছিল বলে তারা ধারণা করছেন। এরপরই এ নিয়ে সর্বত্র আলোচনা শুরু হয়।  গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে কয়েকজন জেলা জজের গাড়ির চাবি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে সরকার অবগত রয়েছে। যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারে আজ (রবিবার) খালেদা জিয়াকে বিএসএমএমইউতে নিয়ে যাওয়া হবে।’ আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের পরপরই বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে সংবাদকর্মীদের ভিড় জমে। আইনমন্ত্রী আরও বলেন, ‘তিনি (খালেদা) রোজা রেখেছিলেন। রোজা রাখার পরে বেলা ৩টা-সাড়ে ৩টার দিকে একটু হেলে পড়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে যে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, ওখানে যে লোক আছেন ফাতেমা তাঁকে ধরে ফেলেন। তাত্ক্ষণিক জেলের ডাক্তাররা তাঁকে দেখেন।’ তিনি বলেন, খালেদা জিয়া যেহেতু রোজা রেখেছিলেন, তাঁর সুগার লেভেল কমে গিয়েছিল বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

ঠিক করবেন আইজি প্রিজন—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে সরকার শতভাগ আন্তরিক বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। গতকাল বেলা ৩টার দিকে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘খালেদা জিয়ার ব্যাপারে তাঁর চিকিৎসকরা আমাদের জানিয়েছেন, উনি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। আমরা আজ দুপুরেই তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। তাঁকে কখন পরীক্ষার জন্য নেওয়া হবে, তা ঠিক করবেন আইজি প্রিজন।’ খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা তাঁকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, কিন্তু তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন নেওয়া হচ্ছে— জানতে চাইলে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এখানেও বড় বড় চিকিৎসকরা রয়েছেন, গবেষকরা রয়েছেন। আবার তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসকরাও রয়েছেন। সুতরাং এখানেই চিকিৎসা হবে। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে সরকার শতভাগ আন্তরিক। খালেদা জিয়ার যদি এর বেশি কিছু প্রয়োজন হয়, আমরা তা দেখব।’ খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়ার বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়া হবে কিনা, এ বিষয়ে বিএনপির কাছে কোনো তথ্য নেই। দল এ বিষয়ে কিছু জানে না। দলের কাছে  কেউ এ বিষয়ে কিছু জানায়নি। খালেদা জিয়ার চিকিৎসা এবং তাঁকে হাসপাতালে আনার বিষয়ে বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনককান্তি বড়ুয়া বিকালে গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখারুজ্জামান বলেন, খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা তাঁরা পাননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পেলে খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়া হবে।

ইউনাইটেডে চিকিৎসা করানো হোক—রিজভী : বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চান না কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এ হাসপাতালে চিকিৎসার ওপর তাঁর আস্থা নেই এবং তিনি সন্তুষ্টও নন। তিনি মনে করেন, সাবেক এই পিজি হাসপাতালে তাঁর যথাযথ চিকিৎসাও হবে না। এ জন্য অবিলম্বে তাঁকে রাজধানীর গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী। গতকাল বিকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যাপারে বেগম জিয়ার ইচ্ছার কথাও জানান। যত দ্রুত সম্ভব ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসার আহ্বান জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, তাইফুল ইসলাম টিপু, বেলাল আহমেদ, সুরুজ্জামান সুরুজ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

ঈদের আগেই মুক্তি চায় শত নাগরিক : ঈদের আগেই মানবিক কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়েছে শত নাগরিক জাতীয় কমিটি। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এ দাবি করেন। তারা বলেন, বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা তাঁর সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছেন, ৫ জুন থেকে তিনি মাইল্ড স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। বেগম জিয়ার জীবন নিয়ে আমরা শংকিতবোধ করছি। আসন্ন ঈদের আগেই মানবিক কারণে তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। বিবৃতিদাতারা হলেন— অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, বিচারপতি আবদুর রউফ, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, অধ্যাপক আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক মোস্তাহিদুর রহমান, আলমগীর মহিউদ্দিন, ডা. এম আজিজুর রহমান, ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী, অধ্যাপক জেড এম তাহমিদা খাতুন, ড. আক্তার হোসেন খান, ড. লুত্ফর রহমান ও আবদুল হাই শিকদার। এ ছাড়া ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ড্যাব, জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনসহ বিএনপিপন্থি বিভিন্ন সংগঠন ঈদের আগেই বেগম জিয়ার মুক্তি চায়। ড্যাবের সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে এম আজিজুল হক ও মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন এক বিবৃতিতে ঈদের আগেই বেগম জিয়ার মুক্তি দাবি করেন। জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, কাদের গণি চৌধুরীসহ ৭০১ জন এক বিবৃতিতে অবিলম্বে বেগম জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন।

খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি মুলতবি : কুমিল্লায় নাশকতার অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি আজ সোমবার পর্যন্ত মুলতবি করেছে হাই কোর্ট। গতকাল বিচারপতি মো. শওকত হোসেন ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। এদিকে, ঢাকায় করা মানহানির দুই মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আবেদনের ওপর হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাবে রাষ্ট্রপক্ষ। গতকাল আদালতে জামিন আবেদনের পক্ষে ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি মনিরুজ্জামান রুবেল ও এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। পরে মানিক সাংবাদিকদের জানান, খালেদা জিয়ার ঢাকার মানহানির মামলায় জামিন চেয়ে করা এক আবেদনের ওপর সম্প্রতি একটি আদেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। আদেশে বলেছেন, জামিন আবেদনকারী অন্য মামলায় কারাগারে রয়েছেন সেহেতু এই মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করার কোনো দরকার নেই।

 একইসঙ্গে দ্রুততার সঙ্গে জামিন আবেদন নিষ্পত্তির জন্য ঢাকার চিফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। তিনি বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে মানহানি মামলার ওই আদেশ নিয়ে আপিল বিভাগে আবেদনের কথা বলে সময় নিয়েছেন। এরপর আদালত সোমবার শুনানির জন্য দিন ঠিক করেছেন।

এর আগে মঙ্গলবার এ জামিন আবেদনটি দাখিল করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। ২০ দলীয় জোটের অবরোধ চলাকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রামে বাসে দুষ্কৃতকারীদের ছোড়া পেট্রল বোমার ঘটনায় ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশ বাদী হয়ে এ মামলা করে। ২৮ মে কুমিল্লার একটি আদালতে গ্রেফতার দেখানোর পর জামিন আবেদন করেন খালেদা জিয়া। সে আবেদন নামঞ্জুর করে ৮ আগস্ট পরবর্তী দিন ধার্য করেন আদালত। ওই আদেশের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে জামিনসহ আপিল আবেদন করেন খালেদা জিয়া। এদিকে একই মামলা বাতিলে হাই কোর্টে আরও একটি আবেদন বিচারাধীন রয়েছে।

ঢাকার মানহানির দুই মামলায় আপিল করবে রাষ্ট্রপক্ষ : ঢাকায় করা মানহানির দুই মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আবেদনের ওপর হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাবে রাষ্ট্রপক্ষ। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ কথা জানান। এ বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, আপিলের বিষয়ে সব প্রস্তুতি শেষ। সোমবার সকালেই আপিল আবেদনটি দাখিল করা হতে পারে।

গত ৩১ মে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাই কোর্ট বেঞ্চ ওই দুই মামলায় খালেদার জামিনসহ আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তি করতে নিম্ন আদালতের প্রতি নির্দেশ দেন। গত ২২ মে এ দুই মামলায় জামিন আবেদন করেন খালেদা জিয়া। যুদ্ধাপরাধীদের মদদ দেওয়া ও ভুয়া জন্মদিন পালনের অভিযোগে মামলা দুটি করা হয়।

সর্বশেষ খবর