বুধবার, ১৩ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

পাহাড়ধসে নিহত ১১

পার্বত্য জেলায় বন্যা

রাঙামাটি ও কক্সবাজার প্রতিনিধি

পাহাড়ধসে নিহত ১১

পাহাড়ধসে গতকাল চাপা পড়ে বেশ কয়েকটি পরিবার —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় পাহাড়ধসে ১১ জন নিহত হয়েছেন। গতকাল ভোরে উপজেলার পৃথক পাঁচটি গ্রামে নিহতের এ ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া কক্সবাজারে পাহাড়ধসে গাছ চাপা পড়ে দুজন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে কক্সবাজারে ঝড়ের কবলে পড়ে দুটি ট্রলার ডুবে গেছে। শনিবার রাত থেকে গতকাল রাত পর্যন্ত ২০টি ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছে। ১০ জনকে উদ্ধার করা গেলেও সাগরে ২০ জন জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নিম্নাঞ্চল। প্লাবিত হয়েছে বহু গ্রাম। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন ২০ হাজার মানুষ। কক্সবাজারে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মাতামুহুরী, বাঁকখালী নদী ও রেজু নদের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

রাঙামাটি : জেলার নানিয়ারচর উপজেলায় পাহাড়ধসে ১১ জন নিহত হয়েছেন। গ্রামগুলো হলো সাবেক্ষং ইউনিয়নের বড়পুলপাড়া, ধর্মচানপাড়া, হাতিমারা, ঘিলাছড়ি ও বুড়িঘাট। রাঙামাটির জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ মামুন এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, প্রশাসনের একটি যৌথ দল দিনব্যাপী চেষ্টা চালিয়ে নিহতদের লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। রাঙামাটি জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ধস ঘটনার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পুরো পার্বত্যাঞ্চলে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। এর পরও এখনো পাহাড়ধসের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। মাত্র ২০০ জন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে রাঙামাটি জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত মানুষদের আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যেতে বার বার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোয় মাইকিং অব্যাহত রয়েছে। নানিয়ারচর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কোয়ালিটি চাকমা জানান, রাতে ভারি বৃষ্টিতে পাহাড় ভেঙে মাটি চাপা পড়ে বুড়িঘাট ইউনিয়নের ধরমপাশা কার্বারীপাড়ায় ফুলদেবী চাকমা (৫৫), তার মেয়ে ইতি দেওয়ান (১৯), পুত্রবধূ স্মৃতি চাকমা (২৩), নাতি আয়ুব দেওয়ান (দেড় বছর), নানিয়ারচর বড়পুলপাড়ায় সুরেন্দ্র লাল চাকমা (৫৫), তার স্ত্রী রাজ্যদেবী চাকমা (৫০), মেয়ে সোনালি চাকমা (১৩), নানিয়ারচর ইউনয়নের বড়পুলপাড়ার মহিলা মেম্বারের ছেলে রোমেন চাকমা (১৪), ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের বৃষকেতু চাকমা (৬০), হাতিমারা এলাকার রিপোল চাকমা (১৪) ও রীতা চাকমার (৮) মৃত্যু হয়। তবে অন্য একজনের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। এ ছাড়া টানা বর্ষণে নানিয়ারচর উপজেলার ইসলামপুরে ৪৫টি, বগাছড়িতে ৪২টি ও বুড়িঘাটে একটি স্থানে পাহাড়ধস হয়েছে। এসব এলাকায় মানুষের বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। পাহাড়ঘেঁষে বসবাসরত মানুষদের মাইকিং করে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হচ্ছে। টান বর্ষণে পাহাড়ধসের আতঙ্কে ঘর ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ। এ ছাড়া বরকল উপজেলার সীমান্তবর্তী বড় হরিণা ইউনিয়নের নোয়াদাম গ্রামে সরলমুনি চাকমা (৬৫) নামে এক ব্যক্তি পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছেন। এখনো পর্যন্ত তার লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এদিকে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে বাঘাইছড়ি উপজেলার নিম্নাঞ্চল।

 প্লাবিত হয়েছে মাস্টারপাড়া, পুরাতন মারিশ্যা, মধ্যমপাড়া, বটতলী বাঘাইছড়ি, সারোয়াতলী গুচ্ছগ্রাম, কলেজপাড়া, মুসলিম ব্লক, হাজীপাড়া, মাদ্রাসাপাড়া, খেদারমারা, আমতলী ইউনিয়ন, উগলছড়ি ও বটতলী সড়ক। পানিতে ডুবে গেছে পুকুর ও ৬০০ একরের বেশি আমন খেত। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন উপজেলার প্রায় ২০ হাজার মানুষ। এ ব্যাপারে বাঘাইছড়ি পৌর মেয়র জাফর আলী খান জানান, পাহাড়ি ঢলে পৌর এলাকার বেশকিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী মানুষের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তাদের জন্য রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যদিকে রাঙামাটির বিলাইছড়ি, বরকল, লংগদু, জুরাছড়ি উপজেলায় একইভাবে পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে ফসলি জমি ও বসতঘর। এদিকে, চার দিনের টানা বর্ষণে তছনছ হয়ে গেছে রাঙামাটি শহর। পাহাড়ধসে বিধ্বস্ত হয়েছে অসংখ্য বাড়িঘর। ধসে পড়ছে পিলার, বাড়িঘরের প্লাস্টার ও সীমানাপ্রাচীর। সড়কে সড়কে জমেছে মাটির স্তূপ। উপচে পড়েছে গাছপালা। গতকাল সারা দিন বিদ্যুিবহীন ছিল রাঙামাটি। এ ছাড়া শহরের মানিকছড়ি, রিজার্ভ বাজার, তবলছড়ি, চম্পকনগর, টিটিসি, বিজিবি রোড, ডিয়ার পার্ক, ঘাগড়া, রূপনগর, শিমুলতলী, সাপছড়ি, রাঙাপানি, ভেদভেদী ও পুলিশ লাইনস এলাকায় পাহাড়ধসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. এমদাদ হোসেন জানান, গত চার দিনের টানা বর্ষণে রাঙামাটি জেলায় প্রায় ১২৮টি স্থানে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। রাঙামাটি আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্যাচিংনু মারমা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় রাঙামাটিতে ২৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের এই দিনে রাঙামাটিতে পাহাড়ধসে ১২০ জন প্রাণ হারান। আহত হন অর্ধশতাধিক।

কক্সবাজার : বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে দুটি ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে শনিবার রাত থেকে গতকাল রাত পর্যন্ত অন্তত ২০টি ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটল। এর আগে ট্রলারডুবির ঘটনায় নিখোঁজ জেলের মধ্যে আরও ১০ জনকে একই দিন উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সাগরে এখনো ২০ জনের বেশি জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তত্সংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপের কারণে সাগর উত্তাল রয়েছে। চার দিন ধরে ভারি বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের মাতামুহুরী, বাঁকখালী নদ ও রেজু নদের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মহেশখালী উপজেলার হোয়ানকে পাহাড়ধসে মো. বাদশা মিয়া (৩২) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। গতকাল সকালে পানিরছড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। লঘুচাপের প্রভাবে শনিবার রাত থেকে কক্সবাজারের বঙ্গোপসাগর উত্তাল হয়ে উঠলে মাছধরার ট্রলারগুলো উপকূলে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরতে শুরু করে। কিন্তু উপকূলের কাছাকাছি বিভিন্ন মোহনায় এসে প্রচণ্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় ডুবে যায় অনেক ট্রলার। কিছু ট্রলার সৈকতে তীব্র ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেঙে যায়। এ সময় দুর্ঘটনাকবলিত জেলেরা সাঁতার কেটে কূলে ফিরতে সক্ষম হলেও এখনো অন্তত ২০ জন জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। মাতামুহুরী নদীতে লাকড়ি সংগ্রহের সময় এক যুবক ভেসে গেছে। এখনো তার সন্ধান মেলেনি। এদিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সি-ইন পয়েন্ট ও উখিয়ার ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে অজ্ঞাতনামা দুটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল ভোরে ইনানী ও বিকালে সি-ইন পয়েন্ট থেকে মৃতদেহ দুটি উদ্ধার করে স্থানীয় ?পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, মৃতদেহ দুটি নিখোঁজ জেলেদের হতে পারে। অন্যদিকে উখিয়া উপজেলার জামতলীতে গাছ চাপা পড়ে এক রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ আলীর মৃত্যু হয়। তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের তিন শতাধিক ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। স্থানীয় আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, উত্তর বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। এতে উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা ও সমুদ্রবন্দরসমূহের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সোমবার ভোর ৬টা থেকে গতকাল দুপুর ১টা পর্যন্ত কক্সবাজারে ১১৮ মিমি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

বান্দরবান : তিন দিনের টানা ভারি বর্ষণে প্লাবিত হয়েছে বান্দবানের নিম্নাঞ্চল। বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের বাজলিয়া এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় সারা দেশের সঙ্গে এ জেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে জেলা সদরের মেম্বারপাড়া, আর্মিপাড়া, শেরেবাংলানগর, বরিশালপাড়া, নাইক্ষ্যংছড়ি এবং লামা উপজেলার নিম্নাঞ্চল ও নদীপাড়ের হাজার হাজার ঘরবাড়ি। পাহাড়ধসের আশঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সাঙ্গু নদ ও মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তুমব্রু খালের পানির তোড়ে ভেসে গেছে পাশের রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ইসলামপুর, বনানী স মিল এলাকা, কবিরাজপাড়া, আর্মিপাড়া, ওয়াপদা ব্রিজ এলাকা, কাশেমপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে শতাধিক পরিবার। ভারি বর্ষণে বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। জেলা প্রশাসক জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ও পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের জন্য সব উপজেলায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ছেড়ে যেতে করা হচ্ছে মাইকিং।

খাগড়াছড়ি : সদর, দীঘিনালা ও মহালছড়ি উপজেলার ২৫টি গ্রাম এখন পানির নিচে। এসব গ্রামের সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া চেঙ্গী নদীর দুই কূল উপচে খাগড়াছড়ি শহর, শহরতলি ও আশপাশের অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পৌর বাস টার্মিনাল, সবজি মার্কেট পানির নিচে। শান্তিনগর সড়ক, মহিলা কলেজ সড়ক, আরামবাগ সড়ক, মুসলিমপাড়া সড়ক, শব্দমিয়া সড়ক, খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি সড়ক, দীঘিনালা-মেরুং সড়কসহ বিভিন্ন এলাকার সংযোগ সড়কগুলো ডুবে গেছে। আটকে পড়া লোকদের প্রশাসন, রেড ক্রিসেন্ট ও নিরাপত্তা বাহিনী উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠাচ্ছে। মাইনী ও ফেনী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্ধ হয়ে গেছে জেলার সঙ্গে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন উপজেলার সড়ক যোগাযোগ। বিচ্ছিন্ন রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে খাগড়াছড়িতেও পাহাড়ধসের আশঙ্কা রয়েছে। পৌরসভার পক্ষ থেকে লোকজনদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর