মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

এবার গাজীপুর নিয়ে লড়াই

রফিকুল ইসলাম রনি ও শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

এবার গাজীপুর নিয়ে লড়াই

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের স্থগিত হওয়া নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা তফসিল অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণায় নেমেছেন মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীরা। গতকাল সকাল থেকেই প্রার্থীরা যার যার মতো করে ভোটারদের মন জয় করতে মাইকিং, পোস্টার লাগানোসহ নির্বাচনের আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি সারছেন। মেয়র পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গাজীপুরে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে মাঠে নেমেছেন দুই দলের নেতা-কর্মীরা।

এদিকে নির্বাচনী প্রচারণায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনা। একদিকে নগরবাসী রাত জেগে বিশ্বকাপের খেলা দেখছেন, অন্যদিকে দিনব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণায় মেতে উঠেছেন ভোটার-প্রার্থীরা। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা নিয়ে প্রার্থীরাও যথেষ্ট সচেতন। ভোট হারানোর ভয়ে কোন প্রার্থী কোন দলের সমর্থন করছেন তা কেউই মুখ খুলে বলছেন না। যে ভোটার যে দলের সমর্থক ভোট প্রার্থীরাও সে দলের সমর্থনে কথা বলছেন। সূত্রমতে, নৌকার বিজয়ের মাধ্যমে ‘গাজীপুরের মাটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি’ ও সরকারের জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিতে মরিয়া আওয়ামী লীগ। আর ধানের শীষের বিজয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দিতে লড়াইয়ে বিএনপি। খুলনা সিটির পর এবার জোর লড়াই হবে গাজীপুরে। গাজীপুর সিটিতে গত ১৫ মে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও আইনি জটিলতায় তা প্রায় দেড় মাস পিছিয়ে ২৬ জুন হতে যাচ্ছে। গতকাল নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম দিন আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বিএনপির মিথ্যাচারের জবাব দিয়ে গ্রিন ও ক্লিন গাজীপুর সিটি গড়ার লক্ষ্যে ভোটারদের ভোট প্রার্থনা করেন। অন্যদিকে বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বীরোচিত লড়াইয়ের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভের আশা প্রকাশ করেছেন। ২৬ জুন অনুষ্ঠেয় ভোটের আগে প্রধান দুই দলের মেয়র প্রার্থীরা তাদের পূর্ণশক্তি ও নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে মাঠে নেমেছেন। খুলনা সিটিতে বিজয়ের পর গাজীপুর সিটিকে সিরিয়াসভাবে নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গোপালগঞ্জের পর গাজীপুরকে আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি বলা হয়। প্রথম দিকে দলের ভিতরে নানামুখী সমস্যা ছিল। সমন্বয়হীনতা ছিল নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায়। প্রথমে ভোট গ্রহণ স্থগিত হওয়ায় কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি এখন উন্নত হয়েছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। গতকাল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। এ সময় তিনি বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে সবাইকে আরও সিরিয়াস হতে হবে। প্রথমে আজমত উল্লা খানের সঙ্গে কথা বলে ভোটের মাঠের পরিস্থিতি ও প্রচারণার খোঁজখবর নেন ওবায়দুল কাদের। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আখতারুজ্জামান ও ইকবাল হোসেন সবুজের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাদের সবাইকে বলেন, সব ভেদাভেদ ভুলে নৌকার প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে নেমে পড়তে হবে। কারণ, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জিততেই হবে। স্থানীয় নেতারা ওবায়দুল কাদেরকে জানান, ভোটের মাঠে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। ভোটের মাঠ তাদের পক্ষে আছে। তারাই জিতবেন। ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, এনামুল হক শামীম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণালকান্তি দাস, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীমকুমার উকিল, উপ-দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ।

রাতে গাজীপুরের এমপি জাহিদ আহসান রাসেলের বাসায় বৈঠকে বসেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক অসীমকুমার উকিল, ত্রাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, কেন্দ্রীয় নেতা ডাকসুর সাবেক ভিপি আখতারুজ্জামান, এস এম কামাল হোসেন, মেরিনা জামান, স্থানীয় এমপি জাহিদ আহসান রাসেল, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজসহ স্থানীয় নেতারা। বৈঠকে প্রার্থীর পক্ষে জোর প্রচারণা ও সরকারের উন্নয়নগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এতে জানানো হয়, প্রথম দিকে দলের যে ছোটখাটো সমস্যা ছিল এখন তা নিরসন হয়েছে। গাজীপুরের আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত। এবারের সিটিতে গাজীপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীই বিজয়ী হবেন। খুলনা সিটিতে পরাজয়ের পর গাজীপুরের ভোটকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। গতকাল সিটির বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ, আবদুল্লাহ আল নোমান, বেগম সেলিমা রহমান, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, শওকত মাহমুদ, ডা. এ জেড এন জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক, ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, গিয়াস কাদের চৌধুরী, যুগ্মমহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম প্রমুখ। গতকাল গাজীপুর সিটির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাত জেগে খেলা দেখলেও প্রার্থীদের মধ্যে যেন ক্লান্তির ছাপ নেই নির্বাচনী প্রচারণায়। আর এতে বিশ্বকাপে এবারের গাজীপুর সিটি ভোট জমজমাট হয়ে উঠেছে। তবে সিটি ভোটে নতুন করে যুক্ত হওয়া বিশ্বকাপের উন্মাদনাকে বাড়িয়ে দিতে প্রার্থীরা পাড়া-মহল্লায় নিজ খরচে বসিয়েছেন বড় বড় পর্দা। কেউ দোকানে, চা-স্টলে বসিয়েছেন রঙিন টেলিভিশন। আর কৌশলী এ প্রচারণায় কেউ কারও প্রতি অভিযোগের তীর ছুড়লেও উল্টো কে বড় পর্দা বা বেশি পর্দা বসাবেন এমন নীরব প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছেন প্রার্থীরা। তবে এমন কৌশলী প্রচারণায় মেয়র প্রার্থীদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা। এর মধ্যে নগরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডেই বসানো হয়েছে অন্তত ১০টি, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৫টি, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৫টি বড় পর্দা। আর এমন অবস্থা এখন পুরো সিটি এলাকায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাউন্সিলর প্রার্থী বলেন, ‘অনেকে একসঙ্গে মিলিত হয়ে খেলা দেখা এক অন্যরকম আনন্দ। আর এমন আনন্দে একটু যুক্ত হয়েছি আর কি।’ তবে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দায়িত্বরত রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডল বলেন, ‘এমন কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। তবে নির্বাচনী পরিবেশ খুবই ভালো। আশা রাখি একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারব আমরা।’

 

এদিকে মেয়র প্রার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীরাও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে আলোচনার তুঙ্গে এখন বড় দুই রাজনৈতিক দলের মেয়র প্রার্থীর প্রচারণা। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম মহানগরের সব মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে সকাল ১০টার দিকে বোর্ডবাজার এলাকা থেকে প্রচারণা শুরু করেন। অন্যদিকে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বিকালে নগরের সর্বত্তরের কাউলতিয়া থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করেন। আর এ প্রচারণায় সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে প্রার্থীদের।

গতকাল সকালে মহানগরের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম আনুষ্ঠানিক প্রচারণায় নামেন। নগরের বোর্ডবাজার এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয় থেকে এ প্রচারণা শুরু করেন তিনি। পরে সাবেক গাছা ইউনিয়ন এলাকার বিভিন্ন মহল্লায় প্রচারণা করেন নৌকার প্রার্থী জাহাঙ্গীর। এ সময় মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি আজমত উল্লা খান বলেন, ‘গাজীপুরকে গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য জাহাঙ্গীরের বিকল্প নেই। প্রার্থীর পক্ষে আমরা সবাই যদি ঘরে ঘরে ভোট চাই তাহলে ২৬ জুন নির্বাচনে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত হবে।’ মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি নগরবাসীর সেবক হতে চাই। গত পাঁচ বছর গাজীপুরবাসী উন্নয়নবঞ্চিত হয়েছেন। গাজীপুর সিটিকে ঢাকার পাশে দ্বিতীয় ঢাকারূপে একটি অত্যাধুনিক শহর হিসেবে গড়তে চাই। ঘরে ঘরে মা-বোনদের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাই। আপনারা আমাকে নৌকা মার্কায় ভোট দিন, আমি আপনাদের একটি আধুনিক পরিকল্পিত নগর দেব।’

অন্যদিকে, বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার সকালে টঙ্গীর নিজ বাসায় নগরের বিভিন্ন এলাকার নেতা-কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে বিজয় নিশ্চিত করতে নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। বিশেষ করে গ্রেফতার হওয়া বিএনপির মেয়র মনোনয়নপ্রত্যাশী শওকত হোসেন সরকারের জামিনের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পরে মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে নগরের সর্বউত্তরের এলাকা কাউলতিয়া থেকে প্রচারণা শুরু করেন। এ সময় বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বলেন, ‘গাজীপুরের মানুষ উন্মুখ হয়ে বসে আছেন ভোট দিতে। ভোটের মাঠে ধানের শীষের জোয়ার এসেছে। আর এ জোয়ার কেউ আটকে রাখতে পারবে না।’ এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন জেলা বিএনপি সভাপতি ফজলুল হক মিলন, সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল, কালিয়াকৈর পৌর চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান, সদর উপজেলা বিএনপি সভাপতি নাজিম উদ্দিন প্রমুখ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর