বৃহস্পতিবার, ২১ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

অভিযান থামবে না মাদকের বিরুদ্ধে, কৌশলী কঠোরতা

সাখাওয়াত কাওসার

অভিযান থামবে না মাদকের বিরুদ্ধে, কৌশলী কঠোরতা

মাদকবিরোধী অভিযান আরও কঠোর হচ্ছে। আসছে ভিন্ন কৌশলও। আবার গ্রেফতার মাদক ব্যবসায়ীদের জামিনের জন্য তদবিরবাজদেরও রাখা হচ্ছে বিশেষ নজরদারিতে।

মে মাস থেকে শুরু হওয়া এ অভিযানে মাঝে কিছু স্থবিরতা এলেও তা আবারও ক্ষিপ্র হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। মাদক মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবীদের নিরুৎসাহিত করার বিষয়টিও চিন্তা করছেন আইনজীবী নেতারা। অন্যদিকে গত মঙ্গলবার রাতে শেরপুরে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন এক মাদক ব্যবসায়ী। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধেও’ এক মাদক ব্যবসায়ী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিযানের পাশাপাশি দেশের সীমান্তে নজরদারি আরও জোরদার করতে হবে। সীমান্ত সিলগালা করতে না পারলে কখনো মাদক প্রবেশ বন্ধ হবে না। স্থলপথের পাশাপাশি, জল এমনকি আকাশপথেও বাড়াতে হবে নজরদারি। মাদক ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা করা কখনো ঠিক হবে না। তারা আরও বলছেন, সরকারি সংস্থার তদন্তে যেসব ‘গডফাদার’ বা পৃষ্ঠপোষকের নাম এসেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা না গেলে মাদকের মূলোৎপাটন সম্ভব নয়। একই সঙ্গে মাদক সিন্ডিকেটে থাকা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ তাদের।

পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, মাদক অভিযানে শিথিলতা এসেছে তা ঠিক নয়। সারা দেশেই পুলিশ এ নিয়ে কাজ করছে। পবিত্র ঈদের কারণে মাদক ব্যবসায়ীরাও তাদের স্থান পরিবর্তন করেছে। তবে খুব শিগগিরই অভিযান আরও কঠোর হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন মাদক স্পটে অভিযানের পরপরই মাদক বিক্রি হচ্ছে অনেকটা প্রকাশ্যে। অভিযোগ উঠেছে, এসব স্পটে মাদক বিক্রির তথ্য প্রশাসনের কাছেও রয়েছে। তবু রহস্যজনক আচরণ তাদের। কক্সবাজার টেকনাফের পৌরসভার কাউন্সিলর এবং যুবলীগের সভাপতি একরামুল হক র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর মাদকবিরোধী অভিযানে কিছুটা শিথিলতা আসে। এরপর থেকে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জড়িত অনেক মাদক ব্যবসায়ীই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। অভিযানের শুরুতে তাদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেলেও পরবর্তীতে তারা আবারও প্রকাশ্যে চলে আসেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলতে থাকে লোকদেখানো অভিযান। রাজধানীর খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, পল্লবী এলাকায় আগের মতোই চলছে মাদক কেনাবেচা। খিলগাঁও থানার পার্শ্ববর্তী তালতলা মার্কেটের (মুদি মার্কেট) দ্বিতীয় তলায় প্রকাশ্যেই চলছে মাদক কেনাবেচা। তালতলা মার্কেট এবং বিদ্যুৎ অফিসের মধ্যবর্তী রিকশার গ্যারেজে দিনেদুপুরেই চলছে মাদক কেনাবেচা। অভিযোগ রয়েছে, থানা-পুলিশ এবং স্থানীয় এক প্রভাবশালীকে ম্যানেজ করেই চলছে মাদক ব্যবসা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস্্) কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান বলেন, র‌্যাব নিজস্ব কৌশল অনুযায়ী কাজ করে। প্রতিদিনই মাদক উদ্ধার করছে র‌্যাব। চলমান সাঁড়াশি অভিযানের সফলতাও এরই মধ্যে দেখতে পাচ্ছে দেশবাসী। একাধিক সূত্র বলছে, মাদকের বিস্তার রোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৫০০ জনের হিটলিস্টে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নামও রয়েছে। শুরুতে ৫০০ জনের একটি প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করেই তা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বিভাগের ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী এক নেতার ছেলে নদীতে ড্রেজার জাহাজে ইয়াবা তৈরির মেশিন বসিয়েছেন। কাঁচামাল দিয়ে ইয়াবা তৈরি করে নদীপথেই ইয়াবা সরবরাহ করার বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ে অবহিত করেছে একটি সংস্থা। এ বিষয়টিও অবহিত করা হয়েছে, ঢাকা বিভাগের একটি জেলায় নদীপথে ট্রলারে এবং বালুবাহী লাইটারে (ছোট জাহাজ) করে আনা ইয়াবা আনলোড করার ব্যাপারে সব ধরনের ব্যবস্থা করছেন তরুণ এক প্রভাবশালী নেতা। পাবনা জেলার ক্ষমতাসীন এক নেতার জনপ্রতিনিধি ভাই, সীমান্তবর্তী জয়পুরহাট জেলার এক প্রভাবশালী নেতার মাদকে প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা এবং লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে কুয়েত প্রবাসী ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার মাদকের পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি সম্পর্কে জানানো হয়েছে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুজিবুর রহমান জানান, স্থলসীমান্তে মিয়ানমারের সঙ্গে আমরা সমন্বিত পেট্রল চালাচ্ছি। কক্সবাজার এলাকায় আমরা অভ্যন্তরীণ অডহক রিজিয়ন হেড কোয়ার্টার স্থাপন করেছি। একই সঙ্গে রিজিয়ন ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো স্থাপন করেছি আমরা। এ কারণে স্থলপথে আগের মতো ইয়াবা প্রবেশ করতে পারছে না। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এডুকেশন কমিটির চেয়ারম্যান ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী মো. নজিবুল্লাহ হিরু বলেন, মাদক মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনজীবীদের নিরুৎসাহিত করার জন্য পরিকল্পনা আছে। কিন্তু অনেক সময় মামলার আইনগত ত্রুটি থাকার কারণে সহজে আসামিরা জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পায়। এক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের আরও সতর্ক থাকার পরামর্শ তার। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কথিত গডফাদারদের নাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত তালিকায় আছে কিনা তা আমার জানা নেই। যদি থাকে তাহলে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তাদের গ্রেফতারে অভিযানের জন্য নির্দেশিত হবেন। তখন ওই অভিযানের ওপর মানুষের আস্থা আরও বাড়বে।

স্থাপনা উচ্ছেদ : চট্টগ্রাম নগরের আকবরশাহ এলাকার শহীদ লেনে মাদকবিরোধী ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানে রেলওয়ের মালিকানাধীন জায়গায় গড়ে ওঠা বস্তিতে শতাধিক স্থাপনা ও মাদকের আখড়া উচ্ছেদ করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে এ অভিযান পরিচালিত হয়। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (পশ্চিম) মো. ফারুক উল হক বলেন, ‘রেলওয়ের মালিকানাধীন জায়গায় গড়ে ওঠা শহীদ লেন বস্তিতে অভিযানে শতাধিক অবৈধ স্থাপনা ও মাদকের আখড়া উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ বস্তিতে নিয়মিত মাদকের আসর বসত বলে তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে। তাই স্থায়ীভাবে এ অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করা হয়। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো বস্তি উচ্ছেদ করা হবে।’

মাদক ব্যবসায়ী নিহত : শেরপুর সদর উপজেলার চুনিয়ারচর গ্রামে র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে আল আমিন ওরফে ফকির নামে এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। নিহত আল আমিন সদর উপজেলার চুনিয়ারচর গ্রামের মজিবর রহমানের ছেলে। গতকাল দুপুরে শেরপুর সদর থানার পুলিশ মরদেহটি ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করেছে।

রাজধানীতে গুলিবিদ্ধ ১ : রাজধানীতে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানে মাদক সেবন ও বিক্রির অভিযোগে ১০৬ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। মোহাম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হয়েছে ফালু নামের এক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে ১৪টি মাদকের মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামাল উদ্দীন মীর। এ ছাড়া গতকাল জেনেভা ক্যাম্পে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৫১ জনকে গ্রেফতার করেছে। উদ্ধার হয়েছে ৭০০ পিস ইয়াবা। তবে ডিএমপি সূত্র বলছে, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত মাদকবিরোধী অভিযানে ৫৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে ২ হাজার ৫১০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৫৪৪ গ্রাম ৪০ পুরিয়া হেরোইন, ৬০০ গ্রাম গাঁজা, ১০০টি নেশাজাতীয় ইনজেকশন, ৪ বোতল বিদেশি মদ ও ১৫ ক্যান বিয়ার উদ্ধার করা হয়।

মাদক আইনে তাদের বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর