বৃহস্পতিবার, ২১ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জানালেন ব্যাংক মালিকরা

ব্যাংক ঋণে সর্বোচ্চ সুদ ৯ আমানতে ৬ শতাংশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের সব ব্যাংক ঋণের সুদহার কমিয়ে ৯ শতাংশ ও আমানতের সুদ সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। এ সিদ্ধান্ত আগামী ১ জুলাই কার্যকর হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গতকালই এ কথা জানিয়েছেন ব্যাংক মালিকরা।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সংগতি রেখে সুদহার কমানোর লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে বৈঠক করেছেন। তিনি ঋণের সুদহার কমিয়ে ১০ শতাংশের নিচে আনার নির্দেশনা দেন।

এর আগে গতকাল সকালে গুলশানের জব্বার টাওয়ারে সংগঠনের কার্যালয়ে বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের  সভাপতিত্বে ব্যাংক মালিকরা জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে ১ জুলাই থেকে ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশের বেশি সুদ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ব্যাংক মালিকরা তিন মাস মেয়াদি আমানতের ওপর ৬ শতাংশের বেশি সুদ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ বৈঠক শেষে বিএবি নেতারা গতকাল দুপুরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় নজরুল ইসলাম মজুমদার, ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালক জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু এমপিসহ বিএবি নেতারা উপস্থিত ছিলেন। জানা গেছে, ঈদের ছুটির পরপরই ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক জুলাই থেকে বিনিয়োগে মুনাফার হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল তড়িঘড়ি জরুরি সভা ডেকে ঋণের সুদহার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় বিএবি। বৈঠকে নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে আমাদের ঋণের সুদহার কমিয়ে আনাটা এখন সময়ের দাবি। সভায় উপস্থিত ব্যাংক পরিচালকরা বিএবি চেয়ারম্যানের প্রস্তাবে সমর্থন জানান। তিনি বলেন, ‘সিঙ্গেল ডিজিট বলতে বোঝায় ৯ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে কেউ ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ সুদও আরোপ করতে পারবেন না। ৯ শতাংশের মধ্যেই থাকতে হবে।’ বৈঠকে তিনি অভিযোগ করেন যে, ব্যাংকগুলোতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। এটা আগামীতে চলতে দেওয়া হবে না। দেশে ১৫ শতাংশ সুদের ঋণ দিয়ে শিল্পায়ন হবে না। ব্যাংকগুলোতে কু-ঋণ এখন বোঝা হয়ে গেছে। এর কারণ হলো— ঋণের বাড়তি সুদহার। তিনি বলেন, কয়েকটি ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওরা যদি পারে আমরা কেন পারব না? ‘ব্যাংক মালিকদের সব দাবি মেনেছি’, প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য উল্লেখ করে বিএবি চেয়ারম্যান বলেন, এখন সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে হবে। আর মূল্যস্ফীতি যেহেতু ৫ দশমিক ৮ শতাংশ, তাই আমানতের সুদহার হবে ৬ শতাংশ। ইতিমধ্যে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে কথা বলেছি যে, আমরা যে ঋণের সুদ কমাব, কিন্তু বহু লিজিং ও ফাইন্যান্স কোম্পানি আছে, তারা আমানতে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ সুদ দিয়ে গ্রাহকদের টাকা রাখতে বলে, এটা বন্ধ না করলে ব্যাংকের টাকা এসব প্রতিষ্ঠানে চলে যাবে। তিনি আরও বলেন, ১৪ শতাংশ ঋণের সুদ দিয়ে ব্যবসা হয় না। শিল্পায়ন হবে না। সুদের হার না কমালে বিনিয়োগ হবে না। আর ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে কোনো লোক টাকা ফেরত দেবে না। মামলা করে টাকা উদ্ধার করাও অসম্ভব ব্যাপার। এতে ব্যাংক অচল হয়ে যাবে, কিন্তু টাকা উশুল করা যাবে না। বাংলাদেশে এমন কোনো ব্যবসা নেই, যাতে ২৫ শতাংশ লাভ হবে। তাই সুদ কমানো সময়ের ডাক নয় শুধু, জাতির স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, ব্যাংকের স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে সুদের হার কমাতে বাধ্য। কমাতে হবে। এই সময়ে ১২, ১৩ ও ১৪ শতাংশ সুদ দিয়ে কোনো শিল্প টেকসই হবে না। ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালক জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু এমপি বলেন, ‘আপনারা ব্যাংকের পরিচালকরা সবাই ব্যবসায়ী। ঋণের সুদহার কম না থাকলে কীভাবে আপনারা বিনিয়োগ করবেন। বিনিয়োগ না হলে দেশে কর্মসংস্থান হবে না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে না। ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান আবদুর রউফ চৌধুরী বলেন, ‘বাইরের দেশগুলোতে ঋণের সুদহার অনেক কম। আমাদের এখানেও ঋণের সুদ কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু আমাদের বড় সমস্যা হয়ে গেছে খেলাপি ঋণ। এমন অনেক ব্যবসায়ী আছেন ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে সব পণ্য ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এটা কীভাবে বন্ধ করা যায় সরকারের সাহায্য নিয়ে সেই চেষ্টা করতে হবে।’

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিজাম চৌধুরী বলেন, ‘বৈঠক থেকে সবাই মিলে ৬ শতাংশে আমানত আর ৯ শতাংশে ঋণ বিতরণের কথা বলে গেলাম। আর ব্যাংকে গিয়ে এমডিদের বললাম তোমরা তোমাদের মতো কর। সরকারকে খুশি করার জন্য এটা বলেছি। এটা যেন না হয়।’ সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালক আজিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) বিবেচনায় নিয়ে এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

বৈঠকে কয়েকজন পরিচালক সঞ্চয়পত্রে ১১ শতাংশের বেশি সুদহার প্রসঙ্গে বলেন, এ হার সমস্যা নয়। তবে অনেক ব্যবসায়ী এখন সঞ্চয়পত্রে টাকা খাটাচ্ছেন। সঞ্চয়পত্রের এ অপব্যবহার বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদহার কমাতে হবে।

ব্যাংক ঋণের সুদহার কমে গত বছরের মাঝামাঝি এক অঙ্কের ঘরে নেমে আসে। তবে নগদ টাকার টানাটানির ফলে গত বছরের শেষ দিক থেকে বেড়ে আবার ১২ থেকে ১৬ শতাংশে উঠেছে। আর একই সঙ্গে আমানতের সুদহার বেড়ে ৮-১২ শতাংশে উঠেছে। বাড়তে থাকা সুদহার কমানোর লক্ষ্যে গত ১৫ এপ্রিল থেকে ব্যাংকগুলোর বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণের হার কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সরকারি আমানতের অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর পরও সুদহার বাড়তে থাকায় ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার           আহ্বান জানান।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর