বৃহস্পতিবার, ২১ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

চৌত্রিশ বছর পরও রাজনৈতিক ঝড় তোলে ‘অপারেশন ব্লুস্টার’

কুলদীপ নায়ার

চৌত্রিশ বছর পরও রাজনৈতিক ঝড় তোলে ‘অপারেশন ব্লুস্টার’

ভারতের ইতিহাস ট্র্যাজেডির পর ট্র্যাজেডির ইতিহাস। পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসব ট্র্যাজেডির অনেকটিই এড়ানো যেত যার অন্যতম ‘অপারেশন ব্লুস্টার’ নামের সামরিক অভিযান (চালানো হয় ১৯৮৪ সালের ১ থেকে ৮ জুন পর্যন্ত)। শিখদের জন্য স্বাধীন আবাসভূমি ‘খালিস্তান’ গড়ার দাবিতে জর্নেল সিং ভিন্দ্রনওয়ালে জঙ্গি আন্দোলনের দুর্গ বানিয়েছিলেন অমৃতসর শহরে। স্বর্ণমন্দিরের ভিতরে শিখদের সর্বোচ্চ তীর্থ             আকাল তখ্ত ছিল তার আস্তানা। বস্তুত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রই সৃষ্টি করেন তিনি। যে যা-ই বলুক, ভিন্দ্রনওয়ালে শিখদের অন্তরে এখনো শ্রদ্ধার আসনেই আছেন। দিন কয়েক আগেই বিষয়টা উপলব্ধি করেছি। প্রসঙ্গক্রমে আমি বলি, ‘ভিন্দ্রনওয়ালে তো এক সন্ত্রাসী’। শিখ ইতিহাসবিদ খুশবন্ত সিং এ রকম মন্তব্য করে পার পেয়ে গেছেন। আমি পাইনি। ব্যাখ্যা দিলাম, যা বলেছি তা ঘরোয়া মন্তব্য, ভিন্দ্রনওয়ালে সম্পর্কে কোনো ধারণা দেওয়ার মতলব থেকে ওরকম বলিনি। ক্ষমাও চাইলাম। শিখ সম্প্রদায় তবুও রুষ্ট। বলল, আমার ব্যবহারে তারা আহত হয়েছে। শিখ রাজনৈতিক সংগঠন আকালি দলকে খতম করে দিতে চাইতেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ভিন্দ্রনওয়ালের মোকাবিলা করতে গিয়ে সুযোগটা পাওয়া গেল। বস্তুত চোখে যা পড়ছিল ভিতরের ব্যাপার ছিল তার চাইতেও গভীর। রটনা বলছিল, ঘটনার কয়েক মাস পরে সংসদ নির্বাচন নির্ধারিত ছিল। তাই ভোটার সমর্থন জোরদার করবার উদ্দেশ্যে চালানো হয় ব্লুস্টার অভিযান। এই ভাষ্য পরবর্তীকালে ইন্দিরার একান্ত সচিব আর কে ধাওয়ান নিশ্চিত করেছিলেন। ছেলে রাজীব গান্ধী, ভাইপো অরুণ নেহরু আর রাজীবের পরামর্শক অরুণ সিং— এ তিনজনের প্রভাবেই ইন্দিরা সিদ্ধান্ত নেন। স্বর্ণমন্দিরে ঢুকে ভিন্দ্রনওয়ালে আর তার জঙ্গি শিষ্যদের হটিয়ে দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন তিনি। ধাওয়ান বলেন, রাজীব ও দুই অরুণ বিশ্বাস করতেন যে, সফল সেনা অভিযানের পর খুব সহজ হয়ে উঠবে তাদের নির্বাচনী জয়। দৃশ্যত অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেনা অভিযানের প্রস্তাব অনুমোদন করেন ইন্দিরা। আর কে ধাওয়ান দেখেছেন, অভিযানে স্বর্ণমন্দিরের ক্ষয়ক্ষতির ছবিগুলো দেখে ইন্দিরা খুব আফসোস করেছিলেন। দুঃখ প্রকাশ করার জন্য ঘটনাস্থলে যেতে চেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং। তাঁকে নিরুৎসাহিত করা হলে তিনি নিজ উদ্যোগে অসামরিক বিমানে চেপে স্বর্ণমন্দির পৌঁছান। তাঁর জন্য আরও বেদনার ছিল, অভিযান সমর্থন করে আকাশবাণীতে ভাষণ দেওয়া। পরে জৈল সিং আমায় জানান, ভাষণের অনুরোধ এলে তিনি ‘না’ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভেবে দেখলেন, তিনি ‘না’ করলে সরকার ও রাষ্ট্রপতির দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যাবে। তাতে দেশে একটা সংকট সৃষ্টি হবে। তাই তিনি বেতার ভাষণ দিলেন। ভাষণের সময় শাব্দিক অর্থেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন জৈল সিং। স্বর্ণমন্দিরে অভিযানের চড়া মূল্য দেন ইন্দিরা। তাঁর নিরাপত্তারক্ষীর গুলিতে তাঁর প্রাণ গেছে। এরই জের ধরে ভারতের নির্বাচনের ইতিহাসের বৃহত্তম ম্যান্ডেট পেয়ে (লোকসভার ৫৪৪ আসনের মধ্যে ৪২১ আসনের জয়) রাজীব গান্ধী ক্ষমতায় আসেন। আকালি দল ও কেন্দ্রীয় সরকার এবং হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যকার দূরত্ব মোচনের উপায় সন্ধানে গঠিত টিমের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, এয়ার মার্শাল অর্জুন সিং ও ইন্দর কুমার গুজরাল (ইনি পরে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন)। তাদের সঙ্গে আমিও ছিলাম। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেনা অভিযানের দরকার ছিল না। অন্য কায়দায় ভিন্দ্রনওয়ালকে নিস্তেজ করে দেওয়া যেত। ইন্দিরা হত্যার পর দিল্লি নগরী ও আশপাশ এলাকায় শিখবিরোধী যে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, দ্রুতগতিতে তা দমন করা সম্ভব ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ছিলেন নিষ্ক্রিয়। পত্রপত্রিকার সংবাদে বলা হয়, রাজীব বলেন, এ দাঙ্গা স্বতঃস্ফূর্ত। তিনি এ কথাও বলেছেন, ‘বড় কোনো গাছ পড়ে গেলে মাটি তো কেঁপে উঠবেই।’ এখন স্বর্ণমন্দিরে সেনা অভিযানের চৌত্রিশ বছর পরও অপারেশন ব্লুস্টার লন্ডন ও নয়াদিল্লিতে রাজনৈতিক ঝড় তুলছে। কারণ, গোপনীয় ব্রিটিশ চিঠিতে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের সামরিক কর্তৃপক্ষ স্বর্ণমন্দির দখল করে নিতে ভারতকে পরামর্শ দিয়েছে। বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার আর বিজেপি সরকার দাবি করেছে ব্যাখ্যা। যুক্তরাজ্যের জাতীয় মহাফেজখানায় নিয়ম অনুযায়ী ৩০ বছর গোপন দলিল হিসেবে সংরক্ষিত চিঠিগুলো সম্প্রতি অগোপনীয় ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘শিখ সম্প্রদায়’ শীর্ষক ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘এই পরামর্শ জানাজানি হয়ে গেলে ব্রিটেনবাসী ভারতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে পারে।’ ব্রিটিশ পরামর্শ অনুযায়ী ১৯৮৪-এর জুনের অভিযান চালিত হয়েছিল কিনা, তেমন প্রমাণ অবশ্য কোনো চিঠিতেই পাওয়া যায়নি। যুক্তরাজ্যে ভারতীয় হাইকমিশনার পদে আমাকে ১৯৯০ সালে নিয়োগ করা হয়। দেখি, হাইকমিশন ভবনে প্রবেশকালে শিখদের দেহ তল্লাশি করা হচ্ছে। শুধু তাদেরই এ ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। আমি সবার জন্য দুয়ার খুলে দিলাম।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর