বুধবার, ১১ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা
বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন

বাংলাদেশ সরকারি খাতে দুর্নীতির সূচকে পিছিয়ে

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বিভিন্ন দেশের নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা পর্যালোচনা করে তৈরি করা বিশ্বব্যাংকের (সিপিআইএ) সর্বশেষ মূল্যায়ন অনুযায়ী সামাজিক খাতে এগিয়ে থাকলেও স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং সরকারি খাতের দুর্নীতিতে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। পিছিয়ে আছে জনপ্রশাসন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা সূচকেও।

বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন অনুযায়ী স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং সরকারি খাতে দুর্নীতির বিষয়ে উন্নয়ন সহায়তাপ্রাপ্ত নিম্ন আয়ের অন্য (আইডিএ) দেশগুলোর সূচক যেখানে ৬ এর মধ্যে ৩, সেখানে নিম্ন মধ্যম আয়ে উন্নীত হওয়ার পরও বাংলাদেশের সূচক ২ দশমিক ৭। জনপ্রশাসনের দক্ষতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সূচক মাত্র ২ দশমিক ৫, অন্য আইডিএ দেশগুলোর সূচক এখানে ২ দশমিক ৯। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার সূচকে আইডিএ দেশগুলোর রেটিং ২ দশমিক ৮ হলেও বাংলাদেশের রেটিং ২ দশমিক ৫। মেধাস্বত্ব ও সুশাসনের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এ খাতে অন্য আইডিএ দেশগুলোর সূচক ২ দশমিক ৯ হলেও বাংলাদেশের প্রাপ্ত সূচক ২ দশমিক ৫। রাজস্ব আদায়ে সক্ষমতার ক্ষেত্রে অন্য দেশগুলোর সূচক যেখানে ৩ দশমিক ৪ সেখানে বাংলাদেশের অর্জন ৩। বাণিজ্য নীতির ক্ষেত্রে আইডিএ দেশগুলোর সূচক ৩ দশমিক ৮ হলেও বাংলাদেশের ৩ দশমিক ৫।  দেশের আর্থিক খাতের এই রেটিং দেখে বিস্মিত খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বিশ্বব্যাংকের পাঠানো মূল্যায়নে নোট লিখে মন্তব্য করেন, ‘ইজ রিয়েলি দ্যা পারফরম্যান্স ইন ফিনান্সিয়াল সেক্টর সো ব্যাড?’ (আমাদের আর্থিক খাতের কর্মক্ষমতা কি সত্যি এত খারাপ?) 

২০১৭ সালে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা এই কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্টটি (সিপিআইএ) গত ৬ জুন অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বিশ্বব্যাংক। ১৬ জুন অর্থমন্ত্রী এ পর্যালোচনাটি দেখে মন্তব্য লেখেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বিশ্বব্যাংকের নাম উচ্চারণ না করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক খেলা। এসব সূচক দিয়ে তারা দেখায় যে তোমরা গরিব, তোমাদের এত এত দুর্বলতা রয়েছে। নিজেদের বাহাদুরী দেখাতেই তারা খুঁজে খুঁজে এসব সূচক তৈরি করে। এসব সূচক দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিস্থিতি প্রকৃতভাবে উপলব্ধি করা যায় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তবে নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কিছু দুর্বলতা রয়েছে এবং সরকার সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বলেও স্বীকার করেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী।

বিশ্বব্যাংক অবশ্য বলেছে, তারা উন্নয়ন সহায়তাপ্রাপ্ত দেশগুলোর দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতেই প্রতিবছর আইডিএ দেশের নীতি ও কাঠামোগত এই প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়ন করে থাকেন। এর মাধ্যমে তাদের ঋণ সহায়তা কতটা কার্যকরভাবে ব্যবহার হচ্ছে সে সম্পর্কেও তারা ধারণা নেন। সিপিআইএ মূল্যায়ন প্রতিবেদনের সঙ্গে পাঠানো এক চিঠিতে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি কিমিয়াও ফান এসব কথা বলেন। তাদের করা এই সূচকের প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি সম্পর্কে সরকারের কোনো প্রশ্ন থাকলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকনোমিস্ট জাহিদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও বলেছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকে ড. জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অবশ্য সিপিআইএ সূচক সম্পর্কে গণমাধ্যমে কথা বলতে অস্বীকার করেন। তিনি জানান, এটি বিশ্বব্যাংকের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন। কেবল অর্থ মন্ত্রণালয়কে তারা এটি পাঠিয়েছেন। বিশ্বে প্রায় ৮০টি দেশ রয়েছে, যারা বিশ্বব্যাংকের সহজ শর্তের ঋণ-সহায়তা শাখা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সমিতির (আইডিএ) ঋণ পাওয়ার যোগ্য। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর উন্নয়নে শূন্য সুদে বা কম শর্তে আইডিএ সহায়তা দিয়ে থাকে বিশ্বব্যাংক, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। প্রবৃদ্ধি অর্জন ও দারিদ্র্য বিমোচনে গৃহীত বিভিন্ন দেশের সরকারি নীতি ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড মূল্যায়নের জন্য এই সিপিআইএ সূচকটি তৈরি করে ওয়াশিংটনভিত্তিক দাতা সংস্থাটি। কোন দেশ কত আইডিএ সহায়তা বা সহজ শর্তের ঋণ পাবে সেটি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে এই মূল্যায়নটি প্রভাব রাখে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ২০১৭ সালে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার আইডিএ সহায়তা পেয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী বরাদ্দকৃত সহায়তার প্রায় ১০ শতাংশ। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, নীতি কাঠামো, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও সমতা নীতি এবং সরকারি খাত ব্যবস্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান— এ চারটি বিষয়ে মোট ১৬ সূচকের ওপর এই মূল্যায়ন করা হয়েছে।  প্রতিটি খাতে নিচে ১ এবং উপরে ৬ পয়েন্ট ধরা হয়েছে। ১৬টি সূচকের গড় নিয়ে বাংলাদেশের এবারের মোট রেটিং পয়েন্ট দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ২। এটি অন্য আইডিএ দেশগুলোর গড় রেটিংয়ের সমান। সিপিআইএ মূল্যায়ন অনুযায়ী নীতি কাঠামো ও সরকারি খাতের ব্যবস্থাপনা সূচকে পিছিয়ে থাকলেও সামাজিক খাতের সূচকে আবার বেশ এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এ কারণেই বাংলাদেশের গড় সূচক অন্য আইডিএ দেশগুলোর সমান হয়েছে।

যেসব সূচকে এগিয়ে বাংলাদেশ : সিপিআইএ মূল্যায়নে মুদ্রানীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারে বাংলাদেশের সূচক ৬ এর মধ্যে ৪। আইডিএ দেশগুলোর সূচক এখানে ৩ দশমিক ৪। রাজস্ব নীতির ক্ষেত্রে আইডিএ দেশগুলোর সূচক ৩ দশমিক ১ হলেও বাংলাদেশের অর্জন ৩ দশমিক ৫। এ ছাড়া ঋণ পরিশোধ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও অন্য আইডিএ দেশগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে আইডিএ দেশগুলোর গড় রেটিং ৩ দশমিক ২ হলেও বাংলাদেশের অর্জন ৪। সরকারি সম্পদ ব্যবহারেও এগিয়ে বাংলাদেশ। আইডিএ দেশগুলোর রেটিং এ খাতে ৩ দশমিক ৩ হলেও বাংলাদেশের রেটিং ৩ দশমিক ৫। মানব সম্পদ তৈরিতে আইডিএ দেশগুলোর রেটিং ৩ দশমিক ৬ হলেও বাংলাদেশের রেটিং ৪। সামাজিক নিরাপত্তা এবং শ্রম খাতে বাংলাদেশের রেটিং ৩ দশমিক ৫ হলেও আইডিএ দেশগুলোর রেটিং ৩।

সর্বশেষ খবর