শনিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা
রাজনীতির হালচাল
উৎকণ্ঠা মাঠের বিরোধ নিয়ে

অনুপ্রবেশকারীদের সরাতে কঠোর আওয়ামী লীগ

রফিকুল ইসলাম রনি

অনুপ্রবেশকারীদের সরাতে কঠোর আওয়ামী লীগ

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই সারা দেশে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন এবং অনুপ্রবেশকারীদের সরাতে কঠোর হচ্ছেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নিজস্ব উদ্যোগে পরিচালিত জরিপে উঠে এসেছে, বিরোধী পক্ষের জনপ্রিয়তায় নয় বরং দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই আওয়ামী লীগ বিপদে পড়তে পারে। সে কারণে নির্বাচনের আগেই কোন্দল মেটাতে জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের কঠোর বার্তা দিয়েছেন তিনি। আর ক্ষমতার ‘ক্রিম’ খেতে নৌকায় ওঠা সুবিধাবাদীদের বিদায় করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সূত্র মতে, একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জেলায় জেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব-কোন্দল ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে মন্ত্রী, এমপি ও জেলা-উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন প্রকটভাবে দৃশ্যমান। পরস্পরবিরোধী গ্রুপের নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন। মামলাও হচ্ছে পাল্টাপাল্টি। নিজ দলের নেতা-কর্মীরাই প্রতিপক্ষ গ্রুপকে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করছেন, এমন ঘটনাও কম নয়। ফলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন নেতা-কর্মীরা। এমপি-মন্ত্রীরা নিজ আত্মীয়স্বজনসহ একদিকে, তো দলের নেতা-কর্মীরা আরেক দিকে। অনেক জেলায় উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে এমপি-মন্ত্রীর বিরোধ তুঙ্গে। এ সমস্যা এখন বেশিরভাগ উপজেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দুই মেয়াদের সাড়ে নয় বছরে বানের পানির মতো অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কত সংখ্যক বিএনপি-জামায়াতের লোক এখন ‘আওয়ামী লীগ’ এর হিসাব মেলানো কঠিন। ২০০৯ সাল থেকেই বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান শুরু হয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের ব্যাপক সংখ্যক নেতা-কর্মী ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেয়। এটা অব্যাহত থাকে ২০১৬-১৭ এমনকি ২০১৮ সালেও। কেন্দ্রীয় নেতা ও এমপি-মন্ত্রীদের হাত ধরে নৌকায় ওঠা ‘পরগাছাদের’ নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি ছিল তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের। কিন্তু নিজের আধিপত্য ধরে রাখা এবং ‘বিশেষ সুবিধা’র  জন্য বন্ধ হয়নি দলের অনুপ্রবেশ। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের অন্যতম কারণ এই অনুপ্রবেশকারী। তাদের কারণেই দলে ত্যাগী ও দুঃসময়ের নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। সংসদ নির্বাচনের সামনে রেখে এসব বিষয় এখন ভাবিয়ে তুলেছে দলের হাইকমান্ডকে। জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তিন মাসের ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এর অংশ হিসেবে তিনি প্রথমেই বেছে নিয়েছেন তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়। এ জন্য জেলা-উপজেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে প্রথমে ডেকে কথা বলেছেন। দ্বিতীয় ধাপে চার বিভাগের প্রতিটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও দলীয় ইউপি চেয়ারম্যান এবং জেলা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন তিনি। আগামী শনিবার তৃতীয় ধাপে ডাকা হয়েছে বাকি চার বিভাগের নেতা ও চেয়ারম্যানদের। বিগত দিনের দুটি মতবিনিময় সভায় তৃণমূল নেতাদের বক্তৃতায় ফুটে উঠেছে, তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং অনুপ্রবেশের ভয়াবহ চিত্র। তারা বলেছেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের সাংগঠনিক অস্তিত্ব সংকটে থাকলেও অনেক জায়গা আছে যেখানে আওয়ামী লীগকে হারানোর জন্য আওয়ামী লীগই যথেষ্ট। আর ক্ষমতায় থাকায় বাইরে থেকে বহু মানুষ নৌকায় উঠেছে। এভাবে দলে অনুপ্রবেশ যদি আমরা  ঠেকাতে না পারি তবে নৌকা তীর খুঁজে পাবে না।’

নির্বাচনের আগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন এবং সুবিধাবাদী হাইব্রিড, কাউয়া ও পরগাছাদের বের করে দেওয়ার কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুটি বিশেষ বর্ধিত সভায় কোন্দল নিরসন প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘যেসব জায়গায় কোন্দল আছে, সেগুলো দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে হবে। ব্যক্তি স্বার্থে কোনো কোন্দল করা যাবে না। আগামী নির্বাচনে যাকে নৌকা দিব তার পক্ষেই কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে অনুপ্রবেশ ঠেকানো প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, সারা দেশে একটি জরিপ করেছি, দেখা গেছে, বিগত দিনে যারা আমাদের দলের নেতা-কর্মীদের হত্যা করেছে, আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে, সেসব মামলা থেকে বাঁচতে তারা আওয়ামী লীগে ভিড়ছে। দল ভারী করার জন্য কেউ কেউ তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তাদের দলের টানাটানির দরকার নেই। নতুন কর্মী সৃষ্টি করুন।’

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন এবং কোন্দল সৃষ্টিকারী নেতাদের শনাক্ত করতে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্যাহর নেতৃত্বে চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককে সদস্য করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির নেতারা দীর্ঘদিন ধরে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কোন্দল সৃষ্টিকারী নেতাদের নাম শনাক্ত করেছেন। এতে বেশ কয়েকজন দলীয় এমপির নামও রয়েছে। ওই তালিকা ইতিমধ্যে দলীয় সভানেত্রীর হাতে দেওয়া হয়েছে। তালিকা হাতে পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন, নৌকার বিরুদ্ধে বিভিন্ন এলাকায় যেসব নেতা ও সংসদ সদস্যরা অবস্থান নিয়েছে তাদের ভবিষ্যতে এই প্রতীক আর দেওয়া হবে না। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা এমনও বলেন, ‘আরও বেশি করে গ্রুপিং করুক নেতারা।’ শেখ হাসিনা দলীয় কোন্দলের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন বলে জানা গেছে। যারা কোন্দল জিইয়ে রাখবে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবেন তিনি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন দলীয় এমপিকে সতর্ক করা হয়েছে।  এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে কিছু ভুল বোঝাবুঝি অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটা আমরা অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। নির্বাচন অনেক কাছে চলে এসেছে। এ মুহূর্তে দলের মধ্যে সবার ঐক্যবদ্ধ থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করছি, এই কোন্দল থাকবে না।’ দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন দলীয় কোন্দল খুবই কম। তারপরও মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় যে ছোট-খাট বিষয়গুলো বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে, সেগুলো নিরসনের লক্ষ্যে দলীয় সভানেত্রী নিজেই জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের সমাধানের নির্দেশ দিচ্ছেন। সংসদ নির্বাচনের আগে কোনো সমস্যা থাকবে না। তিনি বলেন, কোন্দল জিইয়ে রাখলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে— সে যত বড় প্রভাবশালীই হোক না কেন?

সর্বশেষ খবর