সোমবার, ১৬ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ফের হামলা

সুপ্রিম কোর্টের ১৩ আইনজীবীর নোটিস

বিশ্ববিদ্যালয় ও আদালত প্রতিবেদক

কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ফের হামলা

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর গতকালও হামলা চালানো হয়েছে। আটক সন্তানের মুক্তির দাবিতে মায়ের কান্না —বাংলাদেশ প্রতিদিন

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলাকারীদের বিচার ও আটককৃতদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আবারও হামলা করেছে ছাত্রলীগ। এ সময় আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষকদেরকেও লাঞ্ছিত করা হয়। গতকাল রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ছাড়াও শনিবার সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন ঢাবির দুই শিক্ষার্থী। এর মধ্যে এক ছাত্রীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করা হয়। গতকালের ঘটনা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃত কোটা আন্দোলনকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্ত মুক্তি, ক্যাম্পাসে হামলাকারীদের গ্রেফতার ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে শনিবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় কর্মসূচি দিয়েছিলেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সে অনুযায়ী গতকাল তারা ঘটনাস্থলে আসার আগেই বেলা সাড়ে ১০টার দিকে আইন অনুষদ ভবনের পাশ দিয়ে প্লাকার্ড হাতে মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে যান ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের নেতা-কর্মীরা। অন্যদিকে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের নেতৃত্বে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা শহীদ মিনারের পাদদেশে মানববন্ধনে দাঁড়ান। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শহীদ মিনারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ান। নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষকরা মাইক চালু করে বক্তব্য দিতে থাকেন। এর দুই মিনিটের মধ্যে ছাত্রলীগও নিপীড়নবিরোধীদের মুখের দিকে একটি মাইক ফিট করে বক্তব্য দিতে থাকেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য সৈকত শহীদ মিনারে অবস্থানরত শিক্ষকদের জামায়াত-শিবিরের দোসর উল্লেখ করে বক্তব্য দিতে থাকেন। এ সময় হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। এদিকে মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘বাংলাদেশের মানচিত্র তৈরি হয়েছে শহীদ মিনারকে ঘিরে। শহীদ মিনারকে ভালোবাসি বলে আমরা এখানে। আমরা অতি সাধারণ আর আপনারা অসাধারণ। কারণ আপনারা রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়েছেন। আমরা সাধারণদের রক্ষা করতে চাই।’ গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন নিপীড়িত হয় তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব হয় তাকে রক্ষা করা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা করেনি, পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। প্রশাসন ছাত্রলীগকে ডেকে এনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পিটিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রশাসন কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছে। আমরা সাধারণ শিক্ষকরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা সুন্দর সুষ্ঠুভাবে বিদ্যার চর্চা করবে। তাদের মৌলিক অধিকারের জন্য আন্দোলন করবে এবং সেই আন্দোলন কোনো গুণ্ডা বাহিনী ঠেকাতে পারবে না। আপনারা শক্তিতে বলিয়ান হতে পারেন, কিন্তু আমাদের মনোবল আপনাদের থেকে তুখোর।’ এ সময় ছাত্রলীগের পাশ থেকে শিক্ষকদের ‘গোলাম’ ‘দালাল’ সম্বোধন করে বক্তব্য দেওয়া হয়। এসব শুনে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা গোলাম নয়, আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি।’ এ সময় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা এসে নিপীড়নবিরোধীদের মাইকের তার ছিঁড়ে দেন। পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তানজীমউদ্দিন খান শহীদ মিনারে অবস্থানের ঘোষণা দেন। এ সময় ছাত্রলীগও তাদের দেখাদেখি বসে পড়ে। মিনিট দশ পরে শিক্ষকরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে রওনা হন। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও সেদিকে রওনা হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণাধীন ভবন বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের কাছে গেলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা শুরু করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা চারদিকে ছোটাছুটি করতে থাকেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাদের ওপর বিক্ষিপ্তভাবে হামলা চালান।

শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর সোয়া ১টার দিকে শহীদ মিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের কোনো সহযোগিতা করা হয়নি। বরং প্রশাসন হামলার জন্য আমাদেরকে দুষছেন।’ এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘আমরা নানাভাবে সহযোগিতা চেয়েও কোনো পক্ষের কাছে কোনো সহযোগিতা পাইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদের স্বাধীনতা আছে আপনারা কর্মসূচি পালন করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ও যখন আপনাদের কাছে সহযোগিতা চাইবে তখন আপনারা এগিয়ে আসবেন।’

খুলনা থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, কোটা সংস্কারের দাবিতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় শিক্ষার্থীরা ক্লাস ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। বিক্ষোভ মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন হয়ে শহীদ মিনারের সামনে এসে শেষ হয়। পরে শহীদ মিনারের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদ ও আটককৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবি জানানো হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিভাগটিতে কোনো ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। অবিলম্বে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবি আদায়ের জন্য অন্যান্য বিভাগগুলোকেও এভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে বিভাগটির শিক্ষার্থীরা। এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন ও কর্মসূচিতে যোগদান করতে গেলে বিভাগটির ৪৬তম আবর্তনের শিক্ষার্থী জিসান মাহমুদের মুঠোফোন ভেঙে দেন কতিপয় ছাত্রলীগ কর্মী।

হামলাকারীদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা জানতে চেয়ে লিগ্যাল নোটিস : গত ৩০ জুন ও ১ জুলাই কোটা ব্যবস্থা সংস্কারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভিসিসহ তিন জনকে আইনি নোটিস দেওয়া হয়েছে। গতকাল কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা ফারুক হোসেন ও মো. মশিউর রহমানসহ চারজনের পক্ষে এ নোটিস পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম ও ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়াসহ ১৩ আইনজীবী। নোটিসের বিবাদীরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রক্টর ও রেজিস্ট্রার। নোটিসে বলা হয়, ৩০ জুন কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে ঢাবিতে একটি প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। ওই সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শিক্ষকদের উপস্থিতিতে এ হামলা চালায়। কিন্তু ঢাবির আদেশ ১৯৭৩ অনুসারে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ কারণে ৩০ জুন ও ১ জুলাই কোটা ব্যবস্থা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলাকারীদের ফৌজদারি কার্যকলাপের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নিয়েছে বিবাদীরা তা আমাদের নোটিস প্রাপ্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জানান। তা জানাতে ব্যর্থ হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মক্কেলের নির্দেশনা রয়েছে।

সর্বশেষ খবর