মঙ্গলবার, ১৭ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা
ইতিহাসের সাক্ষী রাশিয়া

মস্কো যেন ভাঙা হাট

বৃষ্টি ভেজা সবুজ গালিচা। স্থানে স্থানে কাদা। চার পাশে নিরাপত্তা প্রহরীরা দাঁড়িয়ে আছে। সেই মাঠেই ফিফার অনুমতি নিয়ে পদচারণা। কিছুক্ষণ আগে এখানে বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলো। লুকা মডরিচ আর আঁতোয়ান গ্রিজমানরা বিশ্বকাপের জন্য লড়াই করল। সেই লড়াইয়ে বিজয়ী ফ্রান্স দল বিশ্বকাপের সোনার হরিণ নিয়ে উদযাপন করল। চ্যাম্পিয়নদের উৎসব মঞ্চটা তখনো সাজানো। যে যার মতো ছবি তুলতে ব্যস্ত। নানা ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে ফ্রেমে বন্দী করে রাখছে মুহূর্তগুলো। মাঠের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন আর্জেন্টাইন সাবেক তারকা পাবলো সোরিন।

ভিডিও কল করে স্ত্রীকে দেখালেন লুঝনিকির সৌন্দর্য্য। যে গোলবারের সামনে দাঁড়িয়ে বিশ্বজয় করেছেন হুগো লরিস সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা করছেন কেউ কেউ। দীর্ঘ এক মাস হাসি-কান্না, ফেবারিটদের বিদায়। নতুন শক্তির উত্থান কত কিছুই না দেখা মিলল। এসবের সাক্ষী হয়ে থাকল রাশিয়া। লুঝনিকি স্টেডিয়ামের সবুজ জমিন এতদিন ছিল নিষিদ্ধ। সেই নিষিদ্ধ মাঠটাই কিছুক্ষণের জন্য সাংবাদিকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল ফিফা। মাঠ কেমন হতে হয়, এ যেন তারই শিক্ষা দেওয়ার একটা ছোট্ট প্রয়াস! আকার আকৃতিতে দেখতে সাধারণ মাঠের মতোই। কিন্তু ঘাস, মাটি, ড্রেনেজ পদ্ধতি সবই আধুনিক। এমনকি অঝোর ধারায় বৃষ্টি হওয়ার পরও মাঠটা শুকাতে শুরু করল আপনা থেকেই। মাঠে যে একটা ফাইনাল ম্যাচ হয়ে গেল, তার কোনো চিহ্নই যেন নেই! ম্যাচের পর শত শত মানুষের পদচারণা মাঠে। কিন্তু কোনো ক্ষতিই যেন হলো না! কী দিয়ে তৈরি এই মাঠ! প্রকৃতির দেওয়া সবুজ ঘাস আছে। আর আছে সিনথেটিক ঘাসের কার্পেট। সবমিলিয়ে মূল মাঠে হাঁটলে মনে হয় মখমল বিছিয়ে রাখা। এই মাঠে হোঁচট খেলেও ভয় নেই। এখানে পরে গেলেও শরীরে আচড়টি লাগে না। বিশ্বকাপের ফাইনাল মঞ্চটা তো এমনই অনিন্দ্য সুন্দর আর আরামদায়ক হওয়া উচিত!

মস্কো এখন ভাঙা হাট : মস্কোর রেড স্কয়ারের চারপাশে শপিং মলের অভাব নেই। বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ড শপগুলো এখানেই। রাশিয়ার লোকাল ব্র্যান্ডগুলোরও বেশির ভাগ এখানে ডেরা গেড়েছে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে সবারই ছিল বিশেষ প্রস্তুতি। শেষ হয়ে গেছে বিশ্বকাপ। এবার বিদায়ের পালা। ফ্রান্স বিশ্বকাপ শিরোপা নিয়ে বাড়ি ফিরছে। ক্রোয়েশিয়া রানার্সআপের সান্ত্বনা নিয়ে। সমর্থকরা ফিরছে সুন্দর কিছু স্মৃতি নিয়ে। আর প্রিয়জনদের জন্য স্যুভেনির নিয়ে। মস্কো এখন ভাঙা হাটের মতোই। হাজার হাজার লোক শেষবারের মতো সবকিছু দেখে নিচ্ছে। কোনো দর্শনীয় স্থান বাদ পড়ে থাকলে সেখানে ছুটে যাচ্ছে। বন্ধুর বাড়ি থাকলে বেড়াতে যাচ্ছে। উপঢৌকন কিনছে প্রিয়জনের জন্য। শপিং মলগুলোতে প্রচণ্ড ভিড়। দাঁড়ানোর স্থান নেই। উপচে পড়া ভিড় ঠেলেই ভাঙা হাটের জিনিস কিনতে ব্যস্ত সবাই।

মস্কোতে দেখার মতো অনেক স্থান আছে। রেড স্কয়ার, ক্রেমলিন, সেন্ট ভাসিলের ক্যাথেড্রাল, গুম আর মস্কোভা নদীই শেষ কথা নয়। এর বাইরেও আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থান। মিউজিয়াম। জার আমলের অনেক প্রাসাদ আর পার্ক। মস্কোতে পার্কের সংখ্যা এতই বেশি, চারদিকে তাকালেই চোখে পড়ে অজস্র গাছপালা। এখানে শহরটা গড়ে উঠেছে প্রকৃতিকে যতটা পারা যায় সংরক্ষণ করে। প্রকৃতির ওপর কোনো তলোয়ার চালানো হয়নি। কেবল মস্কো নয়, অন্যান্য শহরেও রাশিয়ানরা প্রকৃতির ওপর খুব একটা হস্তক্ষেপ করেনি। রাস্তা করার সময়ও খেয়াল রেখেছে প্রকৃতির। পাহাড়ের সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তা উপরে উঠেছে, নিচে নেমেছে। প্রকৃতির বিশেষ যত্ন নিয়েছে বলেই হয়তো ওদের স্বাস্থ্য নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না। এখানে ফলগুলোতে ফরমালিন দেওয়া নেই। সবজিগুলো একেবারেই টাটকা। কোথাও কোনো ভেজাল নেই। খাবার খেলেই পেটে কোনো সমস্যা হয় না। যে কোনো খাবার চোখ বন্ধ করে খাওয়া যায়। ভুল করেও কেউ বাসি খাবার বিক্রি করে না। রাশিয়ানদের এই বিশেষ গুণগুলোই শেষবারের মতো পরখ করে নিচ্ছিল বিশ্বের মানুষ। ফুটবলকে ঘিরে জমা হওয়া লাখ লাখ জনতার স্রোত মস্কোতে। বেশির ভাগই ফিরবে এখান থেকে। মস্কোতে তিনটা এয়ারপোর্ট আছে। সেগুলো দিয়েই রাশিয়ান ইমিগ্রেশন পাড়ি  দেবে। তবে অনেকে সেন্ট পিটার্সবার্গের পথ ধরেছে ফাইনাল দেখেই। ওখান দিয়ে ফিনল্যান্ড হয়ে ইউরোপ দেখতে দেখতে বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা আছে অনেকের। ফিনল্যান্ড উপসাগরের ওপর দিয়ে দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ করে দিয়েছে দুই দেশের সরকার। মস্কোর ভাঙা হাট ছেড়ে কয়েক দিনের মধ্যেই চলে যাবে বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে ছুটে আসা লাখ লাখ মানুষ। মস্কো ফিরবে আগের রূপে। সব সময় নাকি যেখানে খুশি সেখানে যাওয়া যায় না। যেতে গেলে পুলিশের নানান প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। বিশ্বকাপ উপলক্ষে এই ব্যবস্থায় অনেকটা ছাড় দিয়েছিল পুলিশ বিভাগ। কিন্তু ফাইনাল শেষ হতেই দেখা গেল ভিন্ন রূপ। কয়েকজন সাংবাদিক মিলে হোটেলে ফেরার পথে রাতে দেখা পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে। দাঁড় করিয়ে পরিচয়পত্র দেখে নানান প্রশ্নের উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার পরই তারা যেতে দিল। রাস্তায় দাঁড় করিয়ে জেরা করার ধারাটা যে শুরু হবে শিগগিরই এ ঘটনা যেন তারই প্রমাণ। ফুটবলের শহর মস্কো। ফিফা সভাপতি ইনফ্যান্টিনো রাশিয়াকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের এক ফুটবল জাতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে এর প্রমাণ দিয়েছিল রাশিয়া। আর ফাইনালে ‘রা-শি-য়া, রা-শি-য়া’ কোরাস গেয়ে আরও একবার ফুটবলের প্রতি নিজেদের ভালোবাসা জানিয়েছে রাশিয়ানরা। শেষ হয়ে গেল সেই বিশ্বকাপ। যা নিয়ে এতদিন মেতেছিল রাশিয়া। পুরো দুনিয়া। বিদায়বেলায় রাশিয়ান বন্ধুরা ব্যস্ত প্রিয় অতিথিদের শেষবারের মতো আপ্যায়ন করতে। পরিচিতজনরা এ কারণেই ঘুরে বেড়ানোর লোভনীয় প্রস্তাব দেয়। পার্টিতে যাওয়ার দাওয়াত দেয়। এসব আপ্যায়নে এসে অতিথিরাও দাওয়াত দিয়ে যায়। আমাদের দেশটাও দেখতে এসো, বন্ধু। ফুটবলের ভাঙা হাট থেকে অনেকেই অনেক কিছু কিনে নিল। তবে সবচেয়ে দামি আর গর্ব করার মতো জিনিসটা নিয়ে গেলেন দিদিয়ের দেশম। মারিও জাগালো আর ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ারের পর তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে ফুটবলার ও কোচ হিসেবে জিতলেন বিশ্বকাপ শিরোপা। অধিনায়ক ও কোচ হিসেবে ধরলে, দ্বিতীয়। এই রেকর্ডটা আগে ছিল কেবল বেকেনবাওয়ারের।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর