শিরোনাম
বুধবার, ১৮ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

মামলার জালে এক লাখ ৬৮ হাজার কৃষক

হলমার্ক, বিসমিল্লাহ পার পেলেও গড়ে ৩০ হাজার টাকা ঋণের জন্য কৃষকদের নামে ঝুলছে সার্টিফিকেট মামলা

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

ব্যাংক খাত থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটেপুটে নিয়ে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ পার পেয়ে গেলেও জনপ্রতি গড়ে ৩০ হাজার টাকা ঋণের জন্য সারা দেশের প্রায় এক লাখ ৬৮ হাজার কৃষকের নামে এখনো ঝুলছে সার্টিফিকেট মামলা। এদের মধ্যে আবার ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে ১১ হাজার ৭৭২ জন কৃষকের নামে, যারা অর্থ পরিশোধ করতে না পেরে গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী এই চার বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) এই মামলাগুলো করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা এক হালনাগাদ প্রতিবেদনে কৃষিঋণ সার্টিফিকেট মামলার এ তথ্য দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের মে পর্যন্ত দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, সারা দেশের মোট ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৭৫ জন কৃষকের নামে সার্টিফিকেট মামলা চলছে। ১১৯১ সাল থেকে গত ৩৭ বছরে এই মামলাগুলো করা হয়েছে। শুধু চলতি বছর মে মাসেই নতুন করে ৩৪১টি মামলা হয়েছে কৃষকদের নামে। হিসাব অনুযায়ী, প্রত্যেক কৃষকের কাছে ব্যাংকগুলোর গড় পাওনার পরিমাণ মাত্র ৩০ হাজার ৬৬৭ টাকা। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৭৫ জন কৃষকের কাছে ব্যাংকগুলোর মোট পাওনা দাঁড়িয়েছে ৫১৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। আর এই টাকা আদায় করতে ব্যর্থ হয়েই মামলা ঠুকে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, সোনালী ব্যাংকের আড়াই হাজার কোটি টাকা যদি পুনর্ভরণ করতে পারে সরকার, তবে মাত্র ৫০০ কোটি টাকার জন্য লাখ লাখ গরিব কৃষকের নামে বছরের পর বছর মামলা চলবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। সরকারের উচিত ১০-২০ বছরের যেসব মামলা এখনো চলছে, সেগুলোর অর্থ হিসাব করে ব্যাংকগুলোকে পুনর্ভরণ করে দেওয়া। এতে মামলাও কমবে, কৃষকরাও রেহাই পাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, ছোট ছোট এই ঋণ আদায়ে শুরুতেই মামলা না করে আপস-মীমাংসার জন্য একাধিকবার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে। এর ফলে ব্যাংকের টাকাও উদ্ধার হয়, আবার খেলাপি কৃষকও হয়রানি থেকে বেঁচে যায়। এ ধরনের নির্দেশনায় কিছু ফল মিলেছে বলেও জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কৃষিঋণ বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে কৃষকের বিরুদ্ধে এই ছয়টি ব্যাংকের অনিষ্পন্ন সার্টিফিকেট মামলার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার। আর জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬২ কোটি টাকা। চলতি বছরের মে পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত ১৬ মাসে মামলা কমেছে প্রায় ১১ হাজার ৮২৫টি, যার মধ্যে মে মাসে নিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৩৩৭টি। টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)। এই ব্যাংকটি একাই ৮১ হাজার ৫৫৫ জন কৃষকের নামে মামলা করেছে, যাতে জড়িত অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৭০ কোটি টাকা। বিশেষায়িত আরেক ব্যাংক রাকাব ১৩২ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ায় ২৬ হাজার ১২১ জন কৃষকের নামে মামলা করেছে। বাকি মামলাগুলো করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব মামলায় দরিদ্র এমন অনেক বর্গাচাষি রয়েছেন, যাদের নিজের জমি নেই। দুর্যোগের কারণে বা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ব্যাংক থেকে নেওয়া কৃষিঋণের অর্থ পরিশোধ করতে পারেননি বর্গাচাষি। এদের অনেকে আবার পাঁচ হাজার টাকার মূল ঋণ নিয়েছেন, যা ১০ থেকে ১৫ বছরে সুদে-আসলে বেড়ে দ্বিগুণ বা তার বেশি হয়ে গেছে। ফলে অর্থ পরিশোধ করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে ভূমিহীন বর্গাচাষির জন্য। উপরন্তু মামলা থাকায় নতুন করে তারা কোনো ব্যাংক ঋণ নিতে পারছেন না। ফলে তারা অর্থ পরিশোধের সুযোগও পাচ্ছেন না।

সর্বশেষ খবর