বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

মাঠ দখল লিটনের কোণঠাসা বুলবুল

রাজশাহী

জুলকার নাইন, রাজশাহী থেকে

মাঠ দখল লিটনের কোণঠাসা বুলবুল

রাজশাহীর বিমানবন্দরের অভ্যন্তরেই দোকান চালান শফিকুল হোসেন। কথা শুরুই করলেন নির্বাচন দিয়ে। বললেন, ‘স্যার কি ভোট দিতে চলে আসলেন নাকি?’ শুধু শফিকুল নয়, এককালে সিল্কসিটি খ্যাত রাজশাহী এখন মেতে আছে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে।

এর প্রমাণ পাওয়া গেল বিমানবন্দর থেকে মূল শহর হয়ে উপশহর-নিউমার্কেট এলাকা পর্যন্ত আসতেই। এমন কোনো স্থান নেই যেখানে প্রার্থীদের পোস্টার নেই। পুরো শহর ছেয়ে গেছে পোস্টারে। মাথার ওপর, ডানে, বামে, চারদিকে ঝুলছে পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন। রাস্তার পাশে দোকান পরিচালনাকারী কর্মীরাও ব্যাজ ধারণ করেছেন। সবশেষে থাকার জন্য মূল শহরের খ্যাতনামা একটি আবাসিক হোটেলে গেলে সেখানকার রিসিপশনের কর্মীকেও দেখা গেল মার্কা ছাপানো হলুদ রঙের গেঞ্জি পরে দায়িত্ব পালন করছেন। জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাকিব বলেন, আগে উন্নয়নের ছোঁয়া বঞ্চিত থাকা রাজশাহী শহরে সিটি করপোরেশনের বেশ বড় ভূমিকা রয়েছে। প্রথমবার সিটি করপোরেশনের মেয়র হয়ে খায়রুজ্জামান লিটন এখানকার বড় কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন। রাস্তা বড় করে সেখানে দৃষ্টি নন্দন ডিভাইডার দেওয়াসহ ফুটপাথ নির্মাণ করে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনেন। এর বাইরে সিটি মেয়রের তত্ত্ব্বাবধানে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা শহর পরিষ্কার রাখতেন সার্বক্ষণিক। শহর পরিষ্কার রাখার বিষয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা এতটাই তৎপর ছিলেন যে, কারও বাড়ি বা অফিসের সামনে নির্দিষ্ট সময়ের বেশি সময় ময়লা বা অপরিষ্কার কিছু থাকলে আইন করে জরিমানা করা হতো। রাকিবের মতে, এসব কারণে রাজশাহী শহরের মানুষের কাছে উন্নয়ন মানেই হলো সিটি করপোরেশন। এরপর মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনের জন্য তিনি কয়েকদিন আগে পদত্যাগ করেছেন।

আগামী ৩০ জুলাইয়ের নির্বাচনে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন ও বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ধানের শীষ মার্কার প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের মধ্যেই হবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সাধারণভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সাবেক এই দুই মেয়রের একজনকেই নির্বাচিত করবেন রাজশাহীর প্রায় তিন লাখ ১৮ হাজার ভোটার।

গতকাল সরেজমিন রাজশাহী ঘুরে দেখা গেল, শহরজুড়ে থাকা মেয়র পদের ব্যানার ফেস্টুনের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই নৌকার প্রার্থী লিটনের। ধানের শীষের প্রার্থীর পোস্টার চোখে পড়তে একটু বাড়তি দৃষ্টির প্রয়োজন হয়। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও কর্মজীবীরা বললেন, নির্বাচনী আমেজ শুরুর পর থেকেই ব্যানার-ফেস্টুনের বিবেচনায় রাজশাহীর মাঠ আওয়ামী লীগের দখলে, কোণঠাসা হয়ে আছে বিএনপি প্রার্থী। শুরুতেই লিটনের পোস্টারে ছেয়ে ফেলা হয়। এর বেশ কয়েকদিন পর বুলবুলের পোস্টার লাগানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। কয়েকটি স্থানে প্রকাশ্য দিবালোকে বুলবুলের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার কথা জানালেন সাধারণ ভোটাররাই।

নির্বাচনী মাঠ নিয়ে রাজশাহীর রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মন্তব্য, আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরকারদলীয় প্রার্থী হওয়ায় প্রকাশ্যে তার কর্মীর সংখ্যা বিএনপির প্রার্থীর তুলনায় অনেক বেশি। বিএনপির নির্বাচনী ক্যাম্প তৈরির ক্ষেত্রে দলীয় নেতা-কর্মীরা চিন্তাভাবনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে চিন্তার কোনো অবকাশই থাকছে না। এর বাইরে নির্বাচন শুরুর পর থেকেই বিএনপি নেতা-কর্মীরা গ্রেফতার আতঙ্কে আছেন। পুরনো মামলার আসামিরা নির্বাচনী মাঠে নামতে এলেই গ্রেফতার হচ্ছেন। এর বাইরে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে মঙ্গলবার বুলবুলের প্রার্থীর গণসংযোগে বোমা হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা।

জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১৩ সালে মেয়র পদে খায়রুজ্জামান লিটনের পরাজয়কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে শুরু থেকেই গুরুত্বের সঙ্গে মাঠে আছে আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকের সমন্বয়ে কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা রাজশাহী এসে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন। মেয়রের প্রচার প্রচারণার ক্ষেত্রে যেন সংকট তৈরি না হয় এ জন্য সুপরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী থেকে মেয়র প্রার্থীদের আলাদা আলাদা কর্মী নির্ধারণ করে কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া গত পাঁচ বছর বিএনপির প্রার্থী মেয়র থাকাকালীন রাজশাহীর মানুষের উন্নয়ন বঞ্চনা ও লিটন মেয়র থাকাকালীন উন্নয়নের কথা সাধারণ ভোটারদেরও ব্যক্তি লিটনের পক্ষে ভাবতে বাধ্য করছে।

বিপরীতে ভোটের মাঠে দলীয় কোন্দল বিএনপিকে শুরুতেই পিছিয়ে দিয়েছে। এখন প্রকাশ্যে কোন্দল না থাকলেও মাঠে সক্রিয় নয় বিএনপির সব পক্ষ। পোস্টার নিয়ে গেলেও না লাগানোর অভিযোগ আছে দলের মধ্যে। অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও নিষ্ক্রিয়তা আছে বিএনপির দলীয় প্রার্থীর। এক অঙ্গসংগঠনের সভাপতি শুরুতে প্রার্থী হয়ে পরে তুলে নিলেও এই অঙ্গসংগঠনটি মাঠে সক্রিয় নয়। ২০-দলীয় জোটের প্রার্থী হলেও মেয়র পদে বিএনপির সঙ্গে একেবারেই নেই জামায়াত। জামায়াতের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী দিয়ে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন কিন্তু মেয়রের পক্ষে নামতে দলীয় সিদ্ধান্তের কথা বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছেন। গতকাল মহানগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ ও পথসভা করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। এক পথসভায় খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, রাজশাহীর মানুষ বুঝে গেছে কাকে দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব। লিটন বলেন, বিএনপির মেয়র রাজশাহীর উন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছেন। এ জন্য রাজশাহীর মানুষ তার ওপর ক্ষুব্ধ। রাজশাহীর উন্নয়নের স্বার্থে সবাই নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। যেখানেই যাচ্ছি নৌকার পক্ষে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। এককথায় নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে সঙ্গে নিয়ে ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে প্রচার চালানোর বিএনপি প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করবে। আর সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর কী অবস্থা হবে সময় তা বলে দেবে। দেশ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে ভরে গেছে। সরকারের এসব কর্মকাণ্ডে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। জনগণ কিছুতেই এই সরকার ও এই সরকারের প্রার্থীকে মেনে নিতে পারছে না।

সর্বশেষ খবর