সোমবার, ২৩ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভোট এলেই জোট বাড়ে

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

ভোট এলেই জোট বাড়ে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চলছে জোট গঠনের তোড়জোড়। প্রধান দুই জোট তো আছেই, বেশ কয়েকটি ছোট ছোট জোটেরও জন্ম হয়েছে। সবারই লক্ষ্য আগামী নির্বাচন। এসব জোটের কেউ প্রধান দুই দলের পৃষ্ঠপোষকতা চায়, আবার কোনো কোনো জোট বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের জানান দিতে চায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চায় জোট সম্প্রসারণ করে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সুদৃঢ় ঐক্য। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জাতীয়তাবাদী নয়টি দল চড়তে চায় নৌকায়। অন্যদিকে প্রায় ১১ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি চায় সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্য। ঐক্য করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে সরকারকে বাধ্য করতে। একইভাবে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দলের চেয়ারপারসনের মুক্তিও চায় এ দলটি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোট এলেই জোট বাড়ে। এর কারণ, অনেক ছোট দলের তাদের নিজের পায়ে ভর করে ক্ষমতায় যাওয়া বা এমপি হওয়ার সুযোগ নেই। তাই তারা জোট-মহাজোটের সান্নিধ্যে থেকে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এক নেতার এক দল নিয়েই অধিকাংশ জোট। তারপরও সবারই রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। এটা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।  রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা সত্য যে, নির্বাচন যখনই ঘনিয়ে আসে তখন বড় দলগুলোই নিজেদের শক্তি জানান দিতে ছোট দলগুলোর সঙ্গে জোট করে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই এটা এখন লক্ষণীয়।  এতে উভয়পক্ষই লাভবান হয়। যারা কোনো দিন মন্ত্রী-এমপি হওয়ার স্বপ্নও দেখতেন না, সেই ছোট ছোট দলের নেতারা জোটে গিয়ে এমপি-মন্ত্রী হচ্ছেন। আবার আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো দলগুলোও শক্তিমত্তা জানান দিতে ছোটদের সঙ্গে নিচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর কিছু নয়, বরং সৌন্দর্য বলা যায়।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান বলেন, ‘জোটের ব্যাপারে বলতে গেলে অনেক সময় পুরোপুরি একই আদর্শের দল না হলেও কৌশলগত কারণে একাধিক দল একসঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। বামপন্থি দলগুলো একত্রে জোট গঠন করতে পারে বলে শুনেছি। ভারতে বাম দল ক্ষমতায় এসেছে, অনেক বছর টিকেও থেকেছে এটা আমরা দেখেছি। কিন্তু আমাদের দেশের বামদের মধ্যে এত বিভাজন যে, আজ যদি দেখেন তারা জোট করেছে কাল সকালে দেখতে পারেন কেউ কেউ জোট ছেড়ে দিয়েছে। এদের মধ্যে মার্কসবাদী, লেনিনবাদী বিভিন্ন তরিকার লোকজন আছে। কিন্তু আমার মনে হয় যখন জোটের নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল বাধে কেবল তখনই আদর্শিক দ্বন্দ্বগুলোকে সামনে এনে এরা জোট ভেঙে দেয়। আসলেই যদি বাম দলগুলো এক হয় এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এটা অবশ্যই আমাদের রাজনীতির অত্যন্ত ভালো দিক। তবে জোটবদ্ধ হয়ে এলেই এই নির্বাচনে তারা খুব ভালো ফল করবে না এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ, বাম দলগুলো সমাজের শ্রেণি ভাঙতে চায়, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, মানুষে মানুষে সাম্য চায়, কিন্তু মানুষের মধ্যে যে আত্মকেন্দ্রিকতা, সেলফিসনেস এ কারণেই মূলত মানুষ তাত্ত্বিকভাবে বাম দলগুলোকে গ্রহণ করলেও আপন করে নিচ্ছে না।’  সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও ইতিমধ্যে সম্মিলিত জাতীয় জোট গঠন করেছে। জনসমর্থন এবং নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না থাকলেও নিজেরা এক জোট হয়ে ক্ষমতার ভাগিদার হতে চান। দুই প্রধান জোটের বাইরে বাম দলগুলোকে নিয়ে গঠন করা হয়েছে ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’। সবকিছুই চলছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে। বিএনপি থেকে বেরিয়ে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা গঠন করেন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট এলায়েন্স (বিএনএ)। সেখানে সব দলই ‘নামস্বর্বস্ব’। জানা গেছে, আমাদের দেশে তিন দশকের বেশি সময় ধরে জোট গঠন করে ক্ষমতাসীন হওয়ার নজির রয়েছে। ১৯৯৬ সালেই এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর ১৯৯৯ সালে জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোটকে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির সঙ্গে মহাজোট গঠন করে ক্ষমতায় আসে। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জোট ভোট বর্জন করলে মহাজোট থেকে বেরিয়ে জাতীয় পার্টি আলাদা অংশ নেয়।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ১৪ দলীয় জোটে যোগ দেয় আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তরিকত ফেডারেশন। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জোট অংশ নিলে আবারও জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মহাজোট গঠন করা হবে। এ ছাড়াও ১৪ দলীয় জোটের শরিক বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। তার অংশ হিসেবে ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম একাধিক বৈঠক করেছেন কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে। সর্বশেষ ১৮ জুলাই ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক করেন সাবেক বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। বৈঠক শেষে ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পরাজিত করার লক্ষ্যে তৃণমূল বিএনপিসহ নয়টি দল আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চায়। এ জন্য নয়টি দলের নীতিনির্ধারকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি, সিদ্ধান্ত নেবেন শেখ হাসিনা।’ জানা গেছে, নাজমুল হুদার তৃণমূল বিএনপি, ইসলামিক ফ্রন্ট, কৃষক শ্রমিক পার্টি, সম্মিলিত ইসলামিক জোট ও পাঁচ দল নিয়ে গঠিত মোর্চা ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ)। এতে কৃষক শ্রমিক পার্টি, একামত আন্দোলন, জাগো দল, ইসলামিক ফ্রন্ট ও গণতান্ত্রিক জোট। 

সূত্রমতে, ১৮ জুলাই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন নামে আটটি দল নিয়ে একটি জোট গঠন করা হয়েছে। এ জোটের নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’। এ জোট থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা।  এর কিছু দিন আগে গড়া জাতীয় পার্টির জোটে রয়েছে ৫৮টি দল। এর মধ্যে মাত্র দুটি দলের ইসিতে নিবন্ধন রয়েছে। বাকিগুলোর অনেকের রাজনৈতিক কার্যালয়ও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে কয়েকটি দল জোট থেকে সরেও গেছে।

সম্প্রতি গঠিত হয়েছে আরও একটি জোট। নেতৃত্বে রয়েছেন বিকল্প ধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জাসদ (রব) সভাপতি আ স ম রব ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। এ জোটের নাম দেওয়া হয়েছে ‘যুক্তফ্রন্ট’। যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে অবশ্য গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আরও কিছু দলকে টেনে বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চান উদ্যোক্তারা। যুক্তফ্রন্ট একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০ দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত না হয়েও জাতীয় ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে পৃথক প্লাটফর্ম গঠন করতে চায়। জোটে না গেলেও সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গেই থাকবেন তারা। জানা যায়, আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জোটবদ্ধ হতে চাচ্ছে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো। এদের বেশির ভাগই নামসর্বস্ব ও নির্বাচন কমিশনে তাদের নিবন্ধনও নেই। আবার কারও কারও খোদ ঢাকাতেও অফিস নেই। নেতাদের বাসাবাড়িতে চলে কার্যক্রম। এদের মূল লক্ষ্য নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া এবং সব আসনে প্রার্থী দেওয়া। জোট গঠনের এ প্রক্রিয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও নতুন জোট কতটুকু শক্তিশালী হবে তা নিয়ে সন্দেহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর