মঙ্গলবার, ২৪ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার চার্জশিট দাখিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

বহুল আলোচিত হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ২৫ মাসের তদন্ত শেষে গতকাল আদালতে এ চার্জশিট দাখিল করা হয়। নজিরবিহীন এই নারকীয় হামলায় জড়িত ২১ জনকে চিহ্নিত করেছে মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। তবে এদের মধ্যে জীবিত আটজনকে আসামি করা হয়। বাকি ১৩ জন বিভিন্ন অভিযানে নিহত হওয়ায় মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে চার্জশিটে।  অভিযুক্ত আটজনের মধ্যে দুজন এখনো পলাতক। বাকি ছয়জন কারাগারে। তবে নাম নেই ঢাকার নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের।

সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম গতকাল এসব তথ্য দিয়ে বলেছেন, গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল ঘটনার পাঁচ মাস আগে। এখানে হামলা চালানোয় জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বিশ্বের বড় বড় জঙ্গি সংগঠনের অনেক অস্ত্রশস্ত্র আছে। তাই তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এসব অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা পাওয়া যাবে, এমন ধারণা ছিল জঙ্গিদের। মনিরুল ইসলাম বলেন, হলি আর্টিজানে নিহত পাঁচ জঙ্গির মধ্যে নেতৃত্ব দিয়েছিল রোহান ইমতিয়াজ ও খায়রুল ইসলাম পায়েল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশ অস্থিতিশীল করা। বাংলাদেশকে জঙ্গিরাষ্ট্র বানানো। সরকারকে কোণঠাসা করে দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত করা। সরকার যাতে চাপে পড়ে। বিনিয়োগকারীরা যাতে দেশ ছেড়ে চলে যায়। জঙ্গিরা মনে করেছিল, আসল জঙ্গিদের না ধরতে পেরে নিরীহ মানুষকে নির্যাতন-নিপীড়ন করা হবে। এতে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়বে সরকারের ওপর। সাধারণ মানুষ যেন সরকারের ওপর বিক্ষোভ করে। জঙ্গিরা একে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে চার্জশিট আদালতে পাঠিয়ে দিয়েছি। এ মামলায় সব মিলে মোট সাক্ষীর সংখ্যা ২১১ জন। এর মধ্যে ১৪৯ জন ঘটনা সম্পর্কে জানেন কিংবা ঘটনা দেখেছেন। ঘটনার সময়কার ৭৫টি আলামত আদালতে পাঠানো হয়েছে।’

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হলি আর্টিজান ঘটনার আগে জঙ্গিরা আরও কয়েকটি স্থানে রেকি করে। কিন্তু তাদের বিচারে বেরিয়ে এসেছে, তারা হলি আর্টিজানেই হামলা চালাবে। প্রথমত, এখানে নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থা তেমন ছিল না। দ্বিতীয়ত, এ জায়গাটা পালানোর জন্য সুবিধাজনক হবে। পাশাপাশি এ এলাকায় ঘটনা চালালে সর্বোচ্চসংখ্যক বিদেশি একসঙ্গে পাওয়া যাবে। এ কারণেই তারা ঘটনার দু-তিন দিন আগে হলি আর্টিজানকে টার্গেট করে। এ ছাড়া ২৭ রমজান ছিল এ ঘটনার দিন। তারা মনে করেছে, এই জঘন্য কাজে তারা বেশি সওয়াব পাবে।

এ মামলার তদন্ত করতে দুই বছর লাগল কেন? এমন এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, এ ঘটনায় সরাসরি যারা অংশগ্রহণ করেছিল, তারা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। জীবিত কাউকে ধরা যায়নি। ফলে আলামত পরীক্ষা ও প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করতে সময় লেগে যায়। অভিযানকালেও বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে, যাদের জীবিত ধরতে পারলে আরও বেশকিছু তথ্য পেতে পারতাম, আরও দ্রুত তদন্ত শেষ হতো। এ ছাড়া তদন্ত যাতে নির্ভুল হয়, এ কারণে আমাদের কিছু সময় লেগেছে। মনিরুল বলেন, ‘১৭ বিদেশি, তিন বাংলাদেশি নাগরিক ও দুই পুলিশ কর্মকর্তা এ হামলায় নিহত হয়েছেন। তাঁদের আমরা রক্ষা করতে পারিনি, এটি আমাদের ব্যর্থতা। তবে আমরা চেয়েছি নিহত ব্যক্তিদের হত্যাকারী অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে, যাতে তাঁদের স্বজনরা শান্তি পান।’ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এ ঘটনায় ১৭ জন সার্ভাইভার যাঁরা ভিতরে ছিলেন, তাঁদের জবানবন্দি রেকর্ড করিয়েছি, ৭৫টি আলামত বিজ্ঞ আদালতে পাঠিয়েছি। নিহত ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন বিলংইংস (জিনিসপত্র) স্বজনদের কাছে ফেরত দিয়েছি।’

হাসনাত করিমকে আসামি না করার বিষয়ে সিটিটিসির প্রধান বলেন, যারা জীবিত উদ্ধার হয়েছেন, তাদের দেওয়া তথ্যের পাশাপাশি আমরা আরও জানতে পেরেছি, নব্য জেএমবির একটি সাংগঠনিক পরিকল্পনা নিয়ে এ হামলা করা হয়েছে। তাদের এই পরিকল্পনার কোথাও আমরা হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততা পাইনি। এ ছাড়া যারা জীবিত গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের কথায়ও হাসনাত করিমের নাম আসেনি। সুতরাং হাসনাত করিমের দেওয়া ব্যাখ্যার চেয়েও অন্য যারা প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, তাদের জবানবন্দির ওপর আমরা ডিপেন্ড করেছি এবং চার্জশিটে আদালতকে ব্যাখ্যা করেছি।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে কূটনৈতিকপাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। তাদের ঠেকাতে গিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত হন। আহত হন শতাধিক। রাতভর উৎকণ্ঠার পর ২ জুলাই সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে সংকটের অবসান ঘটে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রথমে জঙ্গিরা হলি আর্টিজান টার্গেট করেনি। তারা টার্গেট করেছিল ঢাকার যেখানে বেশিসংখ্যক বিদেশি পাওয়া যাবে, এমন কোনো জায়গা। সে অনুযায়ী তাদের নেতারা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারা টার্গেট করেছিল শহুরে ব্যাকগ্রাউন্ডের কিছু ছেলে লাগবে, সেই কারণে তারা চারজনকে বাছাই করে। একজনকে শোলাকিয়ায় কাজে লাগায়, বাকি তিনজন রোহান ইমতিয়াজ, মোবাশ্বের ও নিবরাস ইসলামকে হলি আর্টিজানে কাজে লাগায়। তাদের যেহেতু পূর্ব অভিজ্ঞতা কম, তাই গাইবান্ধায় একটি ক্যাম্পে কথিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ দেয় এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক অপারেশনে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে পাঠায়। পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাকগ্রাউন্ডের যে দুজন রয়েছে উজ্জ্বল ও পায়েল তারা অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ। তাদের এই তিনজনের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, গুলশান হামলার তদন্তে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মোট ২১ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কারাগারে রয়েছেন ছয়জন। তারা হলেন জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র‌্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান ও হাদীসুর রহমান সাগর। পলাতক দুই আসামি শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে গ্রেফতারি পরোয়ানা চাওয়া হয়েছে। বাকি ১৩ জন নিহত হয় বিভিন্ন অভিযানে। এর মধ্যে হলি আর্টিজানে হামলায় অংশ নেওয়া নব্য জেএমবির পাঁচ জঙ্গি নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল নিহত হয় কমান্ডো অভিযানে। আর পরে জঙ্গিবিরোধী বিভিন্ন অভিযানে হামলার ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ তামিম চৌধুরী, জাহিদুল ইসলাম, তানভীর কাদেরী, নূরুল ইসলাম মারজান, আবু রায়হান তারেক, সরোয়ার জাহান, বাশারুজ্জামান চকোলেট ও ছোট মিজান নিহত হন।

সর্বশেষ খবর