শনিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

ক্ষমতায় থেকেও খুনোখুনি

১০ বছরে ৩৪৭ খুন, আহত ২১ হাজার, নেপথ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজি

মাহবুব মমতাজী

সাড়ে নয় বছর ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ এই সময়ে পদ আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সৃষ্ট দলীয় অন্তঃকোন্দলে রক্তপাত যেন থামছেই না। আধিপত্য বিস্তারের লড়াই, দলীয় অন্তঃকোন্দল আর ক্ষমতার লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের শত্রু এখন আওয়ামী লীগই। গত সাড়ে নয় বছরে খুনের শিকার হয়েছেন ৩৪৭ জন দলীয় নেতা-কর্মী। খোদ রাজধানীতেই খুন হয়েছেন ৩২ জন। এর অধিকাংশই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বলি। নিজেদের মধ্যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে ২২ হাজার ৭৪৪টি। এসব ঘটনায় আহতের সংখ্যা ২১ হাজার ১৮। এসব ঘটনায় হওয়া মামলার প্রায় সবকটিই তদন্ত পর্যায়ে আটকে আছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক) এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। সূত্রমতে, শুধু পদ আর ক্ষমতা ধরে রাখা আর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তৃণমূলে শুধু আওয়ামী লীগই নয়, প্রতিটি সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন একে অন্যের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন দলের প্রভাবশালীরাও। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের ওপর যেন নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে ফেলেছে দলটি। দলের ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়ার দশা হয়েছে। সর্বত্রই ক্ষমতার মোহে যে কোনো মূল্যে পদ আঁকড়ে রাখার প্রতিযোগিতায় সারা দেশেই সৃষ্ট দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রায়শই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হচ্ছে সরকারকে। পদ-পদবি ও আধিপত্য না থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য, তদবির, বদলি, দখল, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিও করা যায় না। এমনকি খোদ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেও দলের প্রভাবশালী নেতাদের একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার আর প্রশ্নবাণে প্রায়শই বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে সরকারকে। ক্ষমতার দাপটে বড়লোক হওয়ার সুযোগসন্ধানীদের এই ঘৃণ্য প্রতিযোগিতায় দলটির তৃণমূলে সাধারণ ও ত্যাগী নেতাদের মধ্যে ক্ষোভেরও কমতি নেই। সে কারণে বাড়ছে খুনোখুনির ঘটনা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা একে দলীয় কোন্দল বলতে নারাজ। তারা বলছেন, এটা ব্যক্তিস্বার্থের কোন্দল। আর একশ্রেণির লোক সুবিধা নেওয়ার জন্য দলে প্রবেশ করে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটাচ্ছেন। সূত্রমতে, ২০০৯-১৪ পর্যন্ত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অন্তত ১৭২ জন নেতা-কর্মী খুন হন। ২০১৫ থেকে চলতি বছরের জুন— মাত্র সাড়ে তিন বছরেই খুনের শিকার হন ১০৩ জন। রাজধানীতে পাঁচ বছর আগে ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই গুলশানে খুন হন আওয়ামী লীগের যুব সংগঠন যুবলীগ ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কী। পরে মিল্কীর অন্যতম হত্যাকারী যুবলীগ নেতা জাহিদ সিদ্দিকী তারেক র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এরপর ২০১৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মতিঝিলে খুন হন যুবলীগ কর্মী রিজভী হাসান বাবু। এরা নিজ দলের ক্যাডারদের হাতেই খুন হয়েছেন। শুধু মতিঝিল নয়, রাজধানীজুড়েই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে অন্তঃকলহ লেগেই আছে। চলতি বছরের এপ্রিল ও জুনে খুন হন আরও দুজন। সর্বশেষ রবিবার সকাল ৭টায় মহাখালীর আমতলীতে জলখাবার হোটেলের পেছনের গলি থেকে রাশেদ (৩৫) নামে এক যুবলীগ কর্মীর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে যারা রাজনৈতিক আদর্শ বিক্রি করেন তারাই চরম পরিণতির শিকার হচ্ছেন। আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ঘটনা ঘটেছে ৩৯টি। এতে নিহত হয়েছেন সাতজন। আহত হয়েছেন ৬০০ জন। গত বছরে ২০৭টি ঘটনায় ৪০ জন নিহত হন। আহত হন ২ হাজার ৮৮৮টি। ২০১৬ সালে ১২৩টি ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হন ২১ জন। আহত হন ২ হাজার ১৩৭ জন। আর ২০১৫ সালে ঘটনার সংখ্যা ছিল ২২৬টি। নিহত হন ৩৩ জন এবং আহত ২ হাজার ৩৭৮ জন।

দেশের বিভিন্ন জেলা শহরের কোনো কোনো স্থানে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে কদিন পরপরই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ময়মনসিংহ শহরে কদিন পরপর গোলাগুলি, বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। জানা গেছে, একই এলাকার মহানগর যুবলীগের সদস্য শেখ আজাদ ও তার বাহিনী যুবলীগ কর্মী শেখ ফরিদ, শেখ ফারুক সমর্থক ও কর্মীদের ওপর কয়েকদিন পরপর হামলা ও সন্ত্রাসী তাণ্ডব চালিয়ে আসছে। ২০ জুন শেখ আজাদসহ তার ৩০-৪০ জন সমর্থক দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্রসহ ককটেল নিয়ে হাবু বেপারী মোড় এলাকায় হামলা চালিয়ে ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি স্বপন সরকারের পায়ে গুলি করে। এ সময় যুবলীগ কর্মী মোর্শেদসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। এর আগে ১৮ মে ক্রমাগত হামলা ও তাণ্ডব চালিয়ে আকুয়া ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কার্যালয়সহ চারটি বাড়িঘর ভাঙচুর করে এ বাহিনী। এ সময় নারীসহ চারজনকে আহত করায় পৃথক অভিযোগে আজাদ শেখের নাম উল্লেখ করে সন্ত্রাসীদের নামে মামলা করেন ভুক্তভোগীরা। এর পাঁচ দিন পর ২৩ মে বিকালে আকুয়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মো. সোহেলকে (৩২) কুপিয়ে গুরুতর আহত করে একই বাহিনীর সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় আজাদ শেখকে আসামি করে মামলা হয় কোতোয়ালি মডেল থানায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এক ‘আজাদ বাহিনীর’ দৌরাত্ম্যে আকুয়া থেকে শুরু করে পুরো ময়মনসিংহ এখন কাঁপছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে চলছে এই বাহিনীর বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের বিস্তার। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিয়াজুল হক খান মিল্কী হত্যার অন্যতম কারণ ছিল মতিঝিলে আধিপত্য বিস্তার, চাঁদার ভাগবাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করে। মিল্কী ও তারেকের মৃত্যুর পর মতিঝিলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান বাবু ও নাসিরের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। বিভিন্ন খাত নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করেই রিজভী হাসান বাবুকে হত্যার অভিযোগ ওঠে নাসির গ্রুপের বিরুদ্ধে। চলতি বছরের ২২ এপ্রিল আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বাড্ডায় খুন হন কামরুজ্জামান দুখু নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী। ১৫ জুন একই এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ফরহাদ আলী নামে আরেকজন। গত বছরের জানুয়ারিতে গুলশানের কালাচাঁদপুরে খুন হন যুবলীগ নেতা মাইনুদ্দীন। ৩ সেপ্টেম্বর আদাবরে খুন হন ওয়ার্ড ছাত্রলীগ নেতা মশিউর রহমান মশু। একই বছরের ৯ আগস্ট মোহাম্মদপুরে খুন হন স্থানীয় যুবলীগ কর্মী তছির উদ্দিন। এ ছাড়া একই কারণে বিভিন্ন সময়ে খুন হন ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ যুবলীগের উপ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক রাজীবুল হাসান রাজীব, খিলগাঁও জোড়পুকুর এলাকার যুবলীগ নেতা আরিফ হোসেন, বাড্ডা জাগরণী সংসদ ক্লাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মোফাজ্জল হোসেন রায়হান, কাফরুলের সৈনিক লীগ নেতা রুবেল হোসেন, বাড্ডায় ঢাকা মহানগরী উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাহবুবুর রহমান গামা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা শামসু মোল্লাসহ চারজন, ওয়ারীতে ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান, মগবাজারে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাহবুবুর রহমান রানা, আগারগাঁওয়ে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম, শ্যামপুরে ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রিয়াজুল ইসলাম লালু, ঢাকা মহানগরী ছাত্রলীগের ৯৪ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি এ কে এম ফজলুল হক পাটোয়ারী ওরফে বাবু, লালবাগ থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আহসানুল হক রতন, মালিবাগে শ্রমিক লীগ নেতা মোক্তার হোসেন, ঢাকা মহানগরী যুবলীগের ৯২ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি শাহ আলী রকিক, ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সায়েদাবাদ টার্মিনালের বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আলম মোল্লা, ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ নেতা আসাদুজ্জামান আল ফারুক, আগারগাঁও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ফজলুল হক, কদমতলীতে থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ ও তার গাড়িচালক, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট এলাকায় স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা কামরুজ্জামান মিঠু, লালবাগে ছাত্রলীগ নেতা রাশেদ সিকদার, মোহাম্মদপুরের ছাত্রলীগ নেতা অহিদুজ্জামান রুমিছ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল কোনো সংগঠনেরই কাম্য নয়। এতে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য ব্যাহত হয় এবং দল করার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি সৃষ্টি হয়; যা সমাজে বড় প্রভাব ফেলে। এটা খুবই দুঃখজনক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর