মঙ্গলবার, ৩১ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

ক্ষোভে রাস্তায় নামল শিক্ষার্থীরা

বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী হত্যার বিচারসহ ৯ দফা দাবি রাজধানী অচল যানজটে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ক্ষোভে রাস্তায় নামল শিক্ষার্থীরা

বিমানবন্দর সড়কে গতকাল দুই সহপাঠী হত্যার প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে অবরোধ-বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাসচাপায় দুই সহপাঠীর মৃত্যুর ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবিতে শিক্ষার্থীদের দিনভর সড়ক অবরোধে রাজধানী ঢাকা ছিল অচল। বিমানবন্দর, মিরপুর সড়ক, বাড্ডা অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এ সময় কিছু গাড়িতেও ভাঙচুর করা হয়। ফলে রাজধানীর প্রায় সব সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। ভোগান্তিতে পড়েন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে হজযাত্রীদের। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয় শিক্ষার্থীদের। সন্ধ্যায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। গতকাল সকাল ১০টায় পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী মানববন্ধন করার কথা ছিল শিক্ষার্থীদের। কিন্তু সড়কের ওপর পুলিশ তাদের দাঁড়াতেই দেয়নি। মানববন্ধনে অংশ নিতে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকটা জোড় করে বিভিন্ন গণপরিবহনে তুলে দিয়ে ফেরত পাঠাতে থাকেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এর এক পর্যায়ে সাড়ে ১০টার দিকে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের সামনে মূল সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন ওই প্রতিষ্ঠানের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী। এতে যোগ দেন রাজধানীর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও শত শত ছাত্রছাত্রী। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ‘জাবালে নূর’ পরিবহনের বাসচালকের কঠোর শাস্তি ও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতসহ নয় দফা দাবি তুলে ধরেন। এমনকি দাবি বাস্তবায়নে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটামও দেন তারা। এ সময় ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলাসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এদিকে ‘জাবালে নূরের চালককে’ আসামি করে ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা করেন বাসচাপায় মারা যাওয়া শিক্ষার্থী দিয়ার বাবা। রবিবার রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে কালশী ফ্লাইওভারের ঢালে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যান শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া ও আবদুল করিম। আহত হন আরও ১৪ জন। এর মধ্যে ছয়জন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সরেজমিন ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনামতে, সকালে রমিজ উদ্দিন কলেজের সামনে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ করলে উত্তরা, কালশী, বনানী ও বারিধারা ডিওএইচএসের সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে পুলিশ হোটেল র‌্যাডিসনের সামনে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা আটকে দেয়। এ সময় কুড়িল ফ্লাইওভার ও খিলক্ষেত থেকে আসা সব গাড়ি উত্তরা এবং বিমানবন্দরের দিকে ঘুরিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। মাতলুব নামে পুলিশের এক এসআই মোটরসাইকেল চালিয়ে গলফ ক্লাবের সামনের রাস্তা অতিক্রম করতে চাইলে শিক্ষার্থীরা বাধা দেন। এতে তিনি গুলি করার হুমকি দিলে ওই এলাকায় চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে ওই পুলিশ কর্মকর্তা ক্ষমা চেয়ে হেঁটে যেতে বাধ্য হন। তবে কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স, গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, হজযাত্রীদের বহনকারী প্রাইভেট কার চলাচল করতে দেওয়া হয়। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে হজযাত্রীসহ সাধারণ মানুষের চরম ভোগান্তির কথা বিবেচনায় নিয়ে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের ইংরেজি প্রভাষক উম্মে কুলসুম শিক্ষার্থীদের অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান। শিক্ষার্থীরা এতে সাড়া না দিলে পুলিশ অ্যাকশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। বিকাল পৌনে ৩টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধাওয়া দিয়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

হজযাত্রী ও প্রবাসীদের ভোগান্তি : শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধে ঢাকা অচল হয়ে পড়ায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিক্ষার হন হজযাত্রীরা। অবরোধের ফলে কুড়িল ফ্লাইওভারে আটকা পড়েন হজযাত্রী আনোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী ফরিদা আখতার। তাদের ফ্লাইট শিডিউল ছিল সাড়ে ৬টায়। হজ ক্যাম্পে তাদের উপস্থিত হওয়ার সময় ছিল দুপুর সাড়ে ১২টা। তারা আগেভাগে পৌঁছানোর বিষয়টি মাথায় রেখে সকাল ৯টার দিকে ডেমরা থেকে রওয়া হন। এরপর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কুড়িল ফ্লাইওভারের ওপরে আটকে পড়েন।

অবরোধে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শত শত শিক্ষার্থী : রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্টের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আশপাশের কয়েকটি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও সড়ক অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। এগুলো হলো ভাসানটেক সরকারি কলেজ, গুলশান কমার্স কলেজ, গুলশান ডিগ্রি কলেজ, মাইলস্টোন কলেজ, বিএফ শাহীন কুর্মিটোলা।

নয় দফা দাবি : নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের ক্ষমা প্রার্থনা, বাসচালকদের গ্রেফতার, লাইসেন্সবিহীন চালকদের গাড়ি চালানো বন্ধ, দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ী বেপরোয়া চালককে ফাঁসি, শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিডব্রেকার দেওয়া, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারের বহন, শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের উঠিয়ে নেওয়া, শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ এবং বাসে অতিরিক্ত যাত্রী না নেওয়ার দাবি জানানো হয়।

সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে অবরোধ : সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজ ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে আশপাশের আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন। এতে সড়কের দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

নৌপরিবহনমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি : নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগ দাবি করেছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে বাসচাপায় শিক্ষার্থীদের মৃত্যু ও খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় আদিবাসী শিশু পূর্ণ ত্রিপুরাকে ধর্ষণের প্রতিবাদে আয়োজিত বিক্ষোভ কর্মসূচিতে এ দাবি করেন ইউনিয়নের নেতারা। বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য দেন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট বাকী বিল্লাহ, ঢাকা মহানগরী পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিপুণ ত্রিপুরা, ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি সুমন সেনগুপ্ত, সহসভাপতি অনিক রায়।

দুই বাসের চালক হেলপার গ্রেফতার : এ ঘটনায় দুই বাসের চালক ও হেলপারকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। গতকাল চারজনকে গ্রেফতারের খবর জানিয়েছে র‌্যাব। র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম জানান, রাতভর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। রবিবার কুর্মিটোলায় বাসচাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ ঘটনায় আহত হয় আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী।

দ্রুত ক্ষতিপূরণের নির্দেশ : রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় নিহত দুই শিক্ষার্থীর পরিবারকে এক সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা করে তাত্ক্ষণিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। জাবালে নূর পরিবহন কর্তৃপক্ষকে এই ক্ষতিপূরণ পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষতিপূরণের অর্থ নিহতদের পরিবার পেল কি না তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে বিআরটিএকে। একই সঙ্গে এ দুর্ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে জাবালে নূর পরিবহনকে চিকিৎসা ব্যয় বহন করতেও নির্দেশ দিয়েছে আদালত। গতকাল জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। দুই শিক্ষার্থীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদনটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল। তিনি নিজেই আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ফরিদা ইয়াসমিন ও মো. মিজানুর রহমান। পরে আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল সাংবাদিকদের বলেন, ‘মর্মান্তিক দুর্ঘটনা রোধে বিদ্যমান ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে নিরাপদ যাত্রী পরিবহন ও যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের নিহত শিক্ষার্থী আবদুল করিম ও দিয়া খানম মিমের পরিবারকে দুই কোটি করে মোট চার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে আদালত।’ তিনি বলেন, ‘আদালত দুই পরিবারের তাত্ক্ষণিক ক্ষতিপূরণ বাবদ জাবালে নূর পরিবহনকে এক সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা করে দিতে বলেছে। পাশাপাশি গণপরিবহনের চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে দেওয়া হয় এবং সড়কে চলাচলকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিআরটিএ কী পদক্ষেপ নিয়েছে সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে বিআরটিএকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ১২ আগস্ট পরবর্তী আদেশের জন্য রাখা হয়েছে। ওই দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে হবে বিআরটিএকে।’ রিটের আর্জি অনুযায়ী কুর্মিটোলার এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় জাবালে নূর পরিবহনের দায় নিরূপণে তদন্ত করতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালককে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। রিটকারী আইনজীবী কাজল বলেন, ‘তদন্তে অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালককে সহযোগিতা করবেন ঢাকার অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) এবং বিআরটিএর চেয়ারম্যান। তাদের দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।’ রিট আবেদনে স্বরাষ্ট্র সচিব, সড়ক পরিবহন সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকার পুলিশ কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক), বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি এবং জাবালে নূর পরিবহন কর্তৃপক্ষকে বিবাদী করা হয়। এর আগে রবিবার বিমানবন্দর সড়কে বাসের অপেক্ষায় থাকা শিক্ষার্থীদের জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া আক্তার মিম ও আবদুল করিমের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন।

 এ ঘটনায় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর যুক্ত করে আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল গতকাল বিচারপতি জে বি এম হাসানের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে উপস্থাপন করে স্বতঃপ্রণোদিত রুল ও নির্দেশনা চাইলে আদালত তাকে বাদী হয়ে রিট আবেদন করতে বলে। একই সঙ্গে ওই দুর্ঘটনায় হতাহতদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে সংশ্লিষ্ট আদালতের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ফরিদা ইয়াসমিনকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দেয়। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট করেন কাজল।

সর্বশেষ খবর