বৃহস্পতিবার, ২ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা
প র্য বে ক্ষ ণ

অভিবাদন শিক্ষার্থীদের এমন বিক্ষোভ দেখেনি স্বদেশ

পীর হাবিবুর রহমান

অভিবাদন শিক্ষার্থীদের এমন বিক্ষোভ দেখেনি স্বদেশ

রাষ্ট্র যেখানে ঘুমিয়ে ছিল, রাজনৈতিক শক্তিসমূহ যেখানে ব্যর্থতা বহন করছিল, প্রশাসন যেখানে নীরব, উদাসীন হয়ে পড়ে ছিল, পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা হয়ে উঠেছিলেন বেপরোয়া সেখানে রাজধানীতে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে। রাজধানী কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। গোটা দেশের মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে সমর্থন-সহানুভূতি আদায় করেছে। স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পরে, পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে ছাত্রছাত্রীরা দ্রোহের আগুনে প্রতিবাদী আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে যে বিক্ষোভ দেখিয়েছে প্রিয় স্বদেশ এমন ছাত্র আন্দোলন অতীতে কখনো দেখেনি। গোটা রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন এমনকি দেশের মানুষকে জাগিয়ে দিয়েছে। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের এই তেজস্বী প্রতিবাদী চেহারা দেখে তাদের অভিবাদন জানাতে হয়। রবিবার রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের কোমলপ্রাণ দুই ছাত্রছাত্রী রাজীব ও মীমকে সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে তাদের রক্তের ওপর ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ-প্রতিরোধে জ্বলে উঠেছিল। সহপাঠী হারানোর বেদনা ও কান্না বারুদ হয়ে জ্বলে উঠেছিল সবখানে। রাজধানীর সব পথে সব স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা নেমে এসেছিল। জাবালে নূর পরিবহন আরেকটি পরিবহনের সঙ্গে রেষারেষির পাল্লা দিতে গিয়ে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরা রাজপথে নেমে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন চালক নিষিদ্ধ করার দাবিতে পাবলিক পরিবহনকে রুখে দিয়েছিল। ক্ষোভের আগুনে কিছু গাড়িতে হামলা-ভাঙচুর হলেও কোথাও হঠকারিতা ছিল না। প্রাইভেট কার অ্যাম্বুলেন্স ও হজযাত্রীদের গাড়ি আটকায়নি। অবরোধ শেষে রোজ ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কারও করেছে। হাতে লেখা পোস্টারগুলোর ভাষা মানুষের হৃদয় কেড়েছে। তারা ক্ষমতার জন্য নয়, রাজনৈতিক কারণে নয়, সরকারবিরোধী মনোভাব থেকেও নয়, কেবল সড়ক হত্যার প্রতিবাদে নিজেদের অধিকার আদায় করতে, নিরাপদ সড়কের জন্য এ আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে চালিয়েছে। পুলিশও আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি সহানুভূতি নিয়ে অবস্থান করেছে। কোনো বাড়াবাড়ি করেনি। র‌্যাব ঘাতক চালকদের আটক করে পুলিশে দিয়েছে। পুলিশ রিমান্ডে নিয়েছে।

মুনাফালোভী নীতিহীন পরিবহন মালিক, আইন লঙ্ঘনকারী বেপরোয়া চালক ও দুর্নীতিগ্রস্ত দায়িত্বহীন ট্রাফিকব্যবস্থাকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছে। মানুষের জীবন কোনো হেলাফেলার বিষয় নয়। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাকে জোরেশোরে জানিয়ে দিয়েছে। রাস্তায় পাবলিক পরিবহন আটকে ফিটনেস সার্টিফিকেট ও চালকদের লাইসেন্স চেক করেছে। কী অভূতপূর্ব তাদের কর্মসূচি। পুলিশ কর্মকর্তাদের মোটরসাইকেল আটকে লাইসেন্স চেক করেছে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদের গাড়ির গতিরোধ করেছে। তিনিও স্নেহশীল হৃদয় নিয়ে নেমে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সরকার, জনগণ, পুলিশ প্রশাসন সব মহল তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘাতক চালকদের গ্রেফতার ও শাস্তির নির্দেশই দেননি, সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে চলতি সংসদের অধিবেশনে পরিবহন আইন পাস করার নির্দেশ দিয়েছেন। আইন মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মানুষের হৃদয় পড়তে পারা রাজনীতিবিদের ভাষায় বলেছেন, ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন যৌক্তিক। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সচিবালয়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করেন এমন দুই মন্ত্রীকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র ও তথ্যমন্ত্রী বৈঠক করে ছাত্রছাত্রীদের সব দাবি মেনে নিয়েছেন। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকেও গতকাল দিনের মতো অবরোধ প্রত্যাহার করে সাত দফা দাবি ঘোষিত হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের পাবলিক পরিবহনে অর্ধেক ভাড়া, সব স্কুল-কলেজের সামনে স্পিডব্রেকার ও জেব্রা ক্রসিং, নিরাপদে হাঁটার জন্য ফুটপাথ, ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিষিদ্ধ, নেশাখোর চালকদের নিয়ন্ত্রণে ডোপ টেস্ট, পরিবহন অধিদফতরকে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে দেওয়াসহ সড়ক হত্যায় দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও দ্রুত বিচারে সব দাবিই যৌক্তিক এবং ন্যায্য। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট বা ফাস্টফুড জেনারেশন বলে যে নতুন প্রজন্মকে আমরা এতদিন রাজনীতি থেকে দূরে আছে বলে অন্যভাবে জানতাম এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারাও জানিয়ে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের সন্তান হিসেবে নিজেদের অধিকারবোধ নিয়ে তারা কতটা সচেতন। এই প্রজন্ম আমাদের ভবিষ্যৎ। রাজনীতি থেকে সব স্তরে জাতীয় জীবনে নেতৃত্বের মহিমায় নিজেদের দেশপ্রেম নিয়ে লেখাপড়া শেষে কাজে লাগাবে। সচেতন নাগরিক হিসেবে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছে অন্যায়ের প্রতিবাদে তারাও প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে জেগে উঠতে পারে। জাগিয়ে দিতে পারে। তাদের এই আন্দোলন চলাকালে গতকাল রাজধানীজুড়ে মানুষ চরম দুর্ভোগের মুখোমুখি হয়। পরিবহন সংকট ও অবরোধের মুখে অনেকে কর্মস্থলে যেতে পারেননি। তবু শতকষ্টে দেশের সন্তানদের নির্মোহ স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ-অনুভূতি নিঃসৃত আন্দোলনের প্রতি হাসিমুখে সমর্থন দিয়েছেন। সরকারের তরফ থেকে যেখানে এই আন্দোলনকে যৌক্তিক বিবেচনায় নিয়ে দাবি মেনে নিয়েছে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সিনিয়র মন্ত্রীরা আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দিতে পারতেন। একই সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী সব স্কুল-কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে বৈঠক করে এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার টেবিলে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানাতে পারতেন। রাজনীতিবিদদের কাছে নিবেদন, মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে কেউ পরিবহন মালিক সমিতি বা শ্রমিক সমিতির নেতা হলে সেই দায়িত্ব ছেড়ে আসবেন। এই বিধান রাখার প্রস্তাব বিবেচনায় নিতে পারেন।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ছাত্রছাত্রীদের রাজপথ ছেড়ে লেখাপড়ায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের কাছে সবিনয় নিবেদন— তোমরা যা করেছ তা ইতিহাস। যে সহপাঠী হারিয়েছ সেই বেদনা পূরণ হওয়ার নয়। যে মা-বাবার বুক খালি হয়েছে তা যেমন পূরণ হবে না তেমন তাদের কান্নাও সারা জীবন ঝরবে। কিন্তু আর কোনো সন্তান যাতে সড়ক হত্যার শিকার না হয়, আর কোনো মা-বাবার বুক যাতে খালি না হয় সেজন্য তোমরা দেশে তীব্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণজাগরণই ঘটাওনি দায়িত্বশীল সব মহলের টনক নাড়িয়ে দিয়েছ। তোমাদের আন্দোলন সফলতা পেয়েছে। সরকার যখন দাবি মেনে নিয়েছে এখন তা কার্যকরের জন্য সময় দিতে হবে। কার্যকরের সময় দিয়ে রাজপথ ছেড়ে তোমরা লেখাপড়ার টেবিলে ফিরে যাও। আন্দোলনের বিজয় অর্জিত হয়েছে। জনদুর্ভোগ যাতে না হয় সেজন্য অবরোধ আপাতত প্রত্যাহার করে নাও।

সর্বশেষ খবর