বুধবার, ৮ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

ফ্যাক্টর আড়াই কোটি তরুণ ভোটার

নতুন প্রজন্মকে জাগিয়ে তুলতে ব্যাপক কর্মসূচি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ

জুলকার নাইন ও গোলাম রাব্বানী

ফ্যাক্টর আড়াই কোটি তরুণ ভোটার

মাত্র চার মাসের মধ্যেই হতে যাওয়া একাদশ নির্বাচনে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় আড়াই কোটি তরুণ ভোটার। বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে হওয়া এই ২ কোটি ৩০ লাখ ভোটারই আগামী নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। ১৮ থেকে ২৮ বছরের এসব ভোটারের সমর্থনেই ঠিক হবে ক্ষমতায় বসবে কোন দল। তরুণ এসব ভোটারের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ যে ভোটের ক্ষেত্রে বড় প্রভাব রাখবে তা জানত দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলই। কিন্তু সর্বশেষ নিরাপদ সড়কের দাবিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আগের সব হিসাব-নিকাশকেই পাল্টে দিয়েছে। নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে রাজনৈতিক দলগুলোকে। তরুণদের প্রত্যাশাগুলো নিয়েও চিন্তা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অন্দরমহলে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পরিকল্পনাও শুরু করেছে তরুণদের আকৃষ্ট করার, আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নানান বিষয় সামনে এনে তরুণ ভোটারদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবে বিএনপি।

নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এখন পর্যন্ত গত ১০ বছরে প্রতি বছর গড়ে ২৫ লাখের মতো ভোটার অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন তালিকায়। এই সময়ে ভোটার বেড়েছে ২ কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজার ৩৭৮ জন। এর মধ্যে ১ কোটি ২১ লাখ ৭৭ হাজার ২১৪ ভোটার আগে কখনোই জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেয়নি। তারা একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রথম ভোট দেবেন। গত ১০ বছরের নতুন ভোটারদের মধ্যে ১৮ বছরের ভোটার রয়েছেন ৪৬ লাখ, ১৯ ও ২০ বছরের ২৭ লাখ, ২১ ও ২২ বছরের ৩৭ লাখ, ২৩ ও ২৪ বছরের ৭০ লাখ, ২৬ বছর বয়সের ভোটার রয়েছেন ৪৭ লাখ। বিগত বিভিন্ন সংসদ নির্বাচনের ভোটের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬২৯ ভোট। আর বিএনপি পেয়েছিল ২ কোটি ২৭ লাখ ৫৭ হাজার ১০০ ভোট। আর অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল ২ কোটি ২৮ লাখ ৩৩ হাজার ৯৭৮ ভোট। আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২ কোটি ২৩ লাখ ৬৫ হাজার ৫১৬ ভোট। সেই হিসাবে নবম থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ভোটার তালিকায় যুক্ত হওয়া তরুণ ভোটাররাই ক্ষমতায় যাওয়ার ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। এক্ষেত্রে যারা যত তরুণ ভোট টানতে পারবেন আগামীতে তারাই ক্ষমতায় যাবেন। শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মতে, তরুণ ভোটাররা অপেক্ষাকৃত শিক্ষা ও প্রগতিশীলতার চিন্তা ধারণ করে। তারা বড়দের মতো অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয় না। অনেক চিন্তাভাবনা করেই ভোটকেন্দ্রে যায় এবং কোন প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেবে সে সিদ্ধান্ত নেয়। সাধারণভাবে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন, জীবনযাপনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগকেই তরুণরা বেশি প্রাধান্য দিত বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে তরুণদের কাছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, নিরাপদ সড়ক, সমাবেশের অধিকারও যে প্রাধান্য পাচ্ছে তা বুঝিয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলো। তাই আগামী নির্বাচনে নিরাপদ সড়ক এবং কোটা পদ্ধতি নতুন করে সাজানোর বিষয়গুলোও তরুণদের ওপর প্রভাব রাখতে পারে।  ভোটার হালনাগাদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে ভোটার সংখ্যা এখন ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১ জন। শুধু এবার ২০১৮ সালে ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ৪৬ লাখ ৫৫ হাজার ৫৪৫ জন নতুন ভোটার। ২০১৭ সালে ভোটার  বেড়েছে ১১ লাখ ৪৪ হাজার, ২০১৫ সালে ভোটার বেড়েছে ১৬ লাখ ৮ হাজার, ২০১৪ সালে ভোটার বেড়েছে ১৯ লাখ ৬৮ হাজার, ২০১৩ সালে ভোটার বেড়েছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার, ২০১২-২০১৩ সালে ভোটার বেড়েছে ৭০ লাখ ৭৯ হাজার এবং ২০০৯-২০১০ সালে ভোটার বেড়েছে ৪৭ লাখ ৭৫ হাজার। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো বলছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের কাছে টানতে চমক দেখাবে আওয়ামী লীগ। নতুন ভোটারদের কাছে টানতে ডিজিটাল চমক দেখানোর কাজ করছে দলটি। শিক্ষিত তরুণ যুবকদের কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভোটারদের কাছে যাবে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, নবম সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা তরুণসমাজ লুফে নেয়। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয় আওয়ামী লীগ। সরকারের প্রথম মেয়াদেই এমন সব পদক্ষেপ নেওয়া হয় যার পরিণামে ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয় বাস্তব। শিক্ষাব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক সম্প্রসারণ ছাড়াও প্রশাসন, ব্যাংকিং, চিকিৎসাসেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং গণযোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে। প্রতিটি ইউনিয়নে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন প্রায় ৪ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। দেশে এখন থ্রি-জি, ফোর-জি চালু হয়েছে। ফাইভ-জি চালুর প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া তরুণদের সরকারি চাকরিসহ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তরুণদের উদ্যোক্তায় রূপান্তর করতে নেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচিকেও সামনে নিয়ে আসছে সরকার। প্রার্থী হিসেবেও দেওয়া হচ্ছে তরুণদের প্রাধান্য। আগামী নির্বাচনে তরুণ ভোটারকে কাছে টানতে তাদের আগ্রহের জায়গাগুলোয় সরকারের উন্নয়নচিত্র তুলে ধরতে ইতিমধ্যেই মন্ত্রণালয়গুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নতুন ভোটাররা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, দেশ গঠনে আওয়ামী লীগের ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের অবদান, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ বিষয়গুলো শ্রেণিভিত্তিক পড়াশোনা করে জেনেছেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এখন বিষয়গুলো তাদের কাছে কেবল নতুন করে উপস্থাপন করছে। তাই বিগত সরকারগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক বিবেচনায় তরুণ ভোটাররা আওয়ামী লীগকেই এগিয়ে রাখবে বলেই মনে করেন ক্ষমতাসীনরা। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে এর আগে ঘোষণা করা ভিশন ২০৩০-তে তরুণদেরকেই টার্গেট করা হয়। সেখানে তরুণদের জন্য প্রযুক্তিবান্ধব ও কর্মমুখী সমাজ গঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত করে বিএনপি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের দুই আন্দোলনে দেখানো রাজনৈতিক সচেতনতা আশাবাদী করেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকদের। তাই মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ কোটার ন্যায্য অধিকারকে সামনে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া বিএনপি তার দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটিকে করেছে তারুণ্য নির্ভর। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একঝাঁক তরুণ নেতাকে প্রার্থী হিসেবে সামনে রেখেই ভোটযুদ্ধে লড়বে দলটি।

সর্বশেষ খবর