সোমবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

শিশুরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে : প্রধানমন্ত্রী

আন্ডারপাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন

বিশেষ প্রতিনিধি

শিশুরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে : প্রধানমন্ত্রী

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের শিশুরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, বিবেককে জাগ্রত করেছে। তাই আশা করব, জনগণ তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সবাই তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবেন। গতকাল সকালে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছে আন্ডারপাস নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে গুজব ছড়ানো থেকে সবাইকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ মিথ্যা অপপ্রচারের জন্য গড়া হয়নি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সামনে রেখে দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা গুজবে কান দেবেন না। ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি সুশিক্ষার জন্য। অশ্লীল কথা, মিথ্যা কথা, গুজব— এসবের জন্য নয়। কাজেই এর থেকে বিরত থাকতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বাঙালিরা একটু হুজুগে মাতি। একটা কথা বলব, সোশ্যাল মিডিয়া, ডিজিটাল বাংলাদেশ তো আমি করে দিয়েছি। সবার হাতে এখন মোবাইল ফোন। আধুনিক প্রযুক্তি ফোর-জি এসে গেছে। একটা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ফেসবুক করা যায়, ইউটিউব দেখা যায়, সেটা আমরা করে দিয়েছি। এই যে প্রযুক্তির ব্যবহার, এর মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে, গুজব ছড়িয়ে, একটা অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা; এমনকি অনেক বয়স্ক লোক, এমন এমন লোক আছে- যাদের ভালো কাজের জন্য একসময় পুরস্কার দিয়েছি, অথচ তারাই যখন এ ধরনের গুজব ছড়াতে শুরু করল। আর যাই হোক, এগুলো তো কখনো সহ্য করা যায় না। কেউ চট করে গুজবে কান দেবেন না।

দুর্ঘটনায় শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচারে নিজের দৃঢ় অবস্থানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা কোনো দিনই ক্ষমা করা যায় না, এটা ক্ষমার অযোগ্য। কারণ, ওই বাস ড্রাইভার যেভাবে নিয়ম ভঙ্গ করে গাড়িটা চালাচ্ছিল, ছেলেমেয়েদের ওপর দিয়ে চলে গেল। অনেক ছেলেমেয়ে আজ আহত। এদের আমরা কখনই ক্ষমা করব না। এ দুর্ঘটনায় যারা জড়িত তাদের উপযুক্ত শাস্তি অবশ্যই হবে, আমরা তা দেব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। ড্রাইভার ও হেলপারদেরও আইন মানতে হবে। ওভারটেকিং না করে লাইন দিয়ে বাস চালাতে হবে। ওভারটেক করতে গেলে তার বিরুদ্ধে তত্ক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে হবে। শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজ চত্বরে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেন। তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত পুলিশ মহাপরিদর্শকের উদ্দেশে বলেন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযথভাবে নির্দেশ দিতে হবে যেন কোনোরকম অনিয়ম না হয়। সড়কে ট্রাফিক সম্পর্কিত অপরাধ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক সময় শনাক্ত করতে পারে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী যানবাহন নিয়ন্ত্রণে সব সড়কে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন ও ডিজিটাল নম্বরপ্লেট ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এর মাধ্যমে লেজার সিগন্যাল দিয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে অনিয়ম শনাক্ত করা যাবে বলেন তিনি। অনুষ্ঠানে রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থীসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় মুহুর্মুহু করতালিতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।

অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বক্তৃতা করেন। স্বাগত বক্তব্যে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ইন চিফ মেজর জেনারেল সিদ্দিকুর রহমান সরকার প্রকল্পসংশ্লিষ্ট উপস্থাপনায় জানান, সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড ৪৩ মিটার দীর্ঘ এই মাল্টিপারপাস অত্যাধুনিক আন্ডারপাসটির নির্মাণকাজ এক বছরের মধ্যে শেষ করবে। সরকারের অর্থায়নে এর ব্যয় নির্ধারিত হয়েছে ৫৪ কোটি টাকা। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামুদ্দিন আহমেদ এবং জ্যেষ্ঠ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী গুজবে কান দিয়ে যারা অস্থিরতা বাড়িয়েছে তাদের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, আমরা সরকারে ফিরে দেখেছি, বিআরটিসি বাস বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা ছিল, আমরা চালু রেখেছি। ড্রাইভারদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কিন্তু দুঃখজনক, ড্রাইভাররা ট্রেনিং করে না, হেলপারের ওপর গাড়ি ছেড়ে দেয়।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ঘটনা ঘটার পর যেভাবে শিক্ষার্থীরা নেমে এসেছিল, তারা যে প্রতিবাদ করেছিল সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, সবাইকে বলেছি ধৈর্য ধরতে। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেখেছি, তোমরা অস্থির হয়ে যাচ্ছ, তবু ধৈর্য ধরতে বলেছি। আমরা দেখেছি, আমাদেও ছেলেমেয়েরা রাস্তায়, তাদের যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। কিন্তু আন্দোলনের তৃতীয় দিন রাস্তায় স্কুলড্রেস পরিবর্তনের দৃশ্য দেখা গেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন দেখলাম ব্যাগের ভিতর থেকে চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল বের হচ্ছে, পাথও বের হচ্ছে তখন আমরা চিন্তিত হয়ে গেলাম। আমি তখনই আহ্বান করলাম, তোমরা ঘরে ফিরে যাও। অভিভাবক-শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানালাম তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়েছে, তাদেরকে ঘরে ফিরিয়ে নিন। সময়মতো তারা শিক্ষাঙ্গনে ফিরে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মার খেয়েছে, অপমানিত হয়েছে, তাদের মোটরসাইকেল পোড়ানো হয়েছে, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ কিছু করেনি। শিক্ষার্থীসহ সবাইকে রাস্তা পারাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, রাস্তা পারাপার করার জন্য ডানে বা বামে তাকাতে হবে। রাস্তা পার হওয়ার জন্য যেসব জায়গা আছে— আন্ডারপাস, ফুটওভার ব্রিজ কিংবা যেখানে জেব্রা ক্রসিং সেখান দিয়ে রাস্তা পার হতে হবে। বাস স্টপেজ ছাড়া কোথাও যাত্রী ওঠানো-নামানো করার বিষয়ে হুঁশিয়ার করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা তা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, শাস্তি দিতে হবে এবং লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। আর ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলতে পারবে না। তিনি বলেন, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেশি মানুষের চলাফেরা যেখানে প্রতিটি জায়গায় আন্ডারপাস, ফুটওভার ব্রিজ করে দিতে হবে। পর্যাপ্ত লাইট ও গোপনভাবে সিসি ক্যামেরা রাখতে হবে এবং তা মনিটরিং করতে হবে। ছোট্ট সোনামণিদের বলব, ট্রাফিক রুলস মেনে চলতে হবে, মন দিয়ে পড়ালেখা করতে হবে। এত কষ্ট করছি তোমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য, সোনার বাংলাদেশ গড়ার সোনার ছেলেমেয়ে তোমরাই।

প্রধানমন্ত্রী প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারি কর্মচারীদের অহেতুক বিলম্ব পরিহারের আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই আন্ডারপাস প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়ন হলে দুটি অমূল্য প্রাণ হয়তো এভাবে ঝরে যেত না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোনো নির্মাণকাজ করতে গেলেই জমির মালিকানা নিয়ে যে সমস্যায় পড়তে হয় সে সমস্যা এখানেও ছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাস্তা কার, জায়গা কার, জমি কার, লেক থাকলে পানি কার এগুলো নিয়ে একটা বিতর্ক থাকে। এ সমস্যাগুলো আর হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, টাকা কে দেবে এজন্য দীর্ঘদিন এই আন্ডারপাসের প্ল্যান করেও বসে থাকা হয়েছে। এখানে যখন র‌্যাডিসন হোটেল হলো, মেডিকেল কলেজ হলো, তার পরে স্কুল ও ফ্লাইওভার করার পর থেকেই এই নকশা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। সবাইকে অনুরোধ করব, আমাদের এখানে বড় বড় আমলারা আছেন, তাদের বলব আপনারা যদি কোনো সমস্যা সমাধান করতে না পারেন, আমি তো রয়েছিই। আমাকে জানানো হলে সেই সমস্যার সমাধান করে দিতে পারি। এজন্য প্রধানমন্ত্রী তার নিজস্ব মোবাইল ফোনে বা অফিসে যোগাযোগের অনুরোধ করেন। অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এই আন্ডারপাস ছাড়াও ঢাকায় আরও তিনটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত একটি এবং সংসদ সদস্য ভবন থেকে সংসদ ভবন পর্যন্ত অরেকটি আন্ডারপাস হবে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, একটি মহল গুজব রটিয়ে উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করে, তারা ভবিষ্যতেও করতে পারে। সেদিকে সবাইকে নজর রাখতে হবে।

সর্বশেষ খবর