মঙ্গলবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

পূর্বাচল স্টেডিয়ামের জায়গা দখল করে নীলা মার্কেট

দিনে লক্ষাধিক টাকা চাঁদাবাজি জায়গা সরকারের, পজিশন বিক্রি করছে প্রভাবশালীরা ফের উচ্ছেদের কথা রাজউক চেয়ারম্যানের

সাঈদুর রহমান রিমন

পূর্বাচল স্টেডিয়ামের জায়গা দখল করে নীলা মার্কেট

পূর্বাচলে অবৈধভাবে জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে নীলা মার্কেট —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বারবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও পূর্বাচল আবাসনে স্টেডিয়ামের জন্য বরাদ্দকৃত জমি থেকে দখলবাজদের হটাতে পারছে না রাজউক। উচ্ছেদ অভিযান শেষ হতেই আবার সেখানে গড়ে উঠছে সারি সারি দোকানপাট, হোটেল, গাড়ির গ্যারেজ, কাঁচাবাজার, মাছবাজার, মিষ্টির কারখানা। শাক-সবজি, তৈজসপত্রের দৈনিক হাটও জমে উঠেছে সেখানে। অবৈধ এ বাজার ঘিরেই সংলগ্ন ৩০০ ফুটের ব্যস্ততম সড়কটির একাংশ দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে গাড়ি পার্কিং পয়েন্ট। একই স্থানে রাস্তার বিপরীত পাশেই গজিয়ে উঠেছে রেন্ট-এ-কারের টার্মিনাল। লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা বৈধ কাগজপত্রহীন কয়েক শ গাড়ি সেখান থেকেই ভাড়ায় চলে। এ টার্মিনাল আর পার্কিং পয়েন্টের কারণে ৩০০ ফুট রোডটি দিন দিনই বিপজ্জনক দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে উঠেছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নীলা মার্কেটে পাকা, আধাপাকা কয়েক শ দোকানঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ৫০০ দোকানপাটের আলাদা কাঁচাবাজারও গড়ে উঠেছে সেখানে। এসব দোকানঘর থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন বিদ্যুৎ, পানি ও পরিচ্ছন্নতার দোহাই দিয়ে প্রতি দোকান থেকে আকারভেদে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে চাঁদাবাজ চক্র। মার্কেটকে ঘিরে ভোলানাথপুরসহ আশপাশ এলাকায় গড়ে উঠেছে মাদকের আস্তানা। এসব আস্তানায় অতি সহজেই পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের মাদক। ফলে এলাকার যুবসমাজও ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে। নীলা মার্কেটের সামনেই রয়েছে একটি কবরস্থান। এ কবরস্থানের ভিতরেই মাদকের মজুদ গড়ে তুলে কেনাবেচা চালানো হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন ও রাজউকের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই রাজউকের জমিতে জবরদখল করে ‘নীলা মার্কেটটি’ নির্মাণ করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি দোকানঘরের পজিশন বিক্রি করা হয়েছে। একেকটি পজিশন ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বেচাকেনা হয়েছে বলেও জানা গেছে। রাজউক পূর্বাচল আবাসনের ভোলানাথপুরে বিশ্বমানের একটি স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনামাফিক প্রায় হাজার কোটি টাকা মূল্যের জায়গাও বরাদ্দ রাখা হয়। স্টেডিয়াম হিসেবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে জায়গাটি বরাদ্দ দিলেও তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনো বুঝিয়ে দেয়নি রাজউক। ফলে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা জায়গার ওপর নজর পড়ে প্রভাবশালী জবরদখলকারীদের। রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলার তত্ত্বাবধানে পাঁচ বছর আগে সেখানে গড়ে তোলা হয় ক্লাবঘরের, নাম দেওয়া হয় ‘আওয়ামী লীগ ক্লাব’। নীলার স্বামী ফটিক আলম ও দেবর আনোয়ার হোসেন এ ক্লাব পরিচালনা করেন। তাদের নেতৃত্বেই ‘আওয়ামী লীগের ক্লাব’ ঘেঁষে একের পর এক দোকানপাট গড়ে ওঠে, চলতে থাকে পজিশন আকারে জায়গা কেনাবেচা। দেখতে দেখতেই সেখানে ৭০০-৮০০ দোকানের বিরাট বাজার জমে ওঠে। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলার নামেই অবৈধ এ বাজারটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘নীলা মার্কেট’।

সেখানে একেকটি দোকানের পজিশন মূল্য বাবদ ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা এককালীন আদায়ের পাশাপাশি ভাড়ার নামে দোকানপ্রতি দৈনিক এক-দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে রাজউক সূত্র বলেছেন, অবৈধভাবে গড়ে তোলা নীলা মার্কেটটিতে অন্তত চার দফা উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই উচ্ছেদ শেষে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আবারও সেখানে দোকানপাট নির্মিত হয়। এর পরও একাধিকবার উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েও পুলিশের সহায়তার অভাবে সফল করা যায়নি। রাজউক সূত্রগুলো জানিয়েছেন, খুব শিগগির আবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে দখলমুক্ত করে জায়গাটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছেন না বাসিন্দারা। পূর্বাচল আবাসনে স্টেডিয়ামের জন্য বরাদ্দকৃত জমি দখলবাজদের সঙ্গে কোনোভাবেই পেরে উঠছে না রাজউক। বর্তমানে জবরদখল স্থায়িত্ব করতে দখলবাজরা পরস্পরের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা সৃষ্টির চক্রান্ত চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। পূর্বাচল উপশহর গড়ে ওঠার লক্ষ্যে ভোলানাথপুরসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি এলাকার রাস্তাঘাট সুন্দর করে নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩০০ ফুট সড়ক দিয়ে খোলামেলা ঘুরে বেড়াতেও ভালো লাগে মানুষের। সড়কের আশপাশ এলাকাগুলো অতি নির্জন। এজন্য বিভিন্ন স্থান থেকেই মানুষজন এখানে ঘুরতে আসে। তাদের টার্গেট করেই নীলা মার্কেট ও আশপাশ এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে মাদকের আস্তানা। বসানো হয়েছে হরেকরকম জুয়ার আসর। র‌্যাব, পুলিশসহ প্রশাসনের চোখের সামনে জবরদখলসহ অবৈধ কর্মকাণ্ড চলে আসছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, মোটা অঙ্কের টাকায় পজিশন কিনে পাকা-আধাপাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, মাসিক ভাড়ার ভিত্তিতে চালানো হচ্ছে দোকানপাট। তাদের নোটিস দিয়ে, মাইকিং করে কিংবা বুলডোজার দিয়ে সহজেই উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে না। সেখানে ক্ষতিপূরণের দাবি-দাওয়া নিয়ে নতুন জটিলতা বাধানোর চেষ্টাও চলছে। ফলে নির্ধারিত স্থানটিতে স্টেডিয়াম গড়ে তোলার কাজটি অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। অবৈধভাবে স্থাপিত ‘নীলা মার্কেট’ উচ্ছেদ না করে এর অনুমোদন চেয়ে রাজউক বরাবর একটি আবেদনপত্র দিয়েছেন স্থানীয় এমপি। কিন্তু রাজউক কর্তৃপক্ষ তাতে অনুমোদন দেয়নি। এ ছাড়া ‘নীলা মার্কেটের’ আশপাশে জুয়ার আসর বসানো হচ্ছে। এসব জুয়ার আসরে প্রতি রাতেই লাখ লাখ টাকার খেলা হচ্ছে। জুয়া খেলতে বেশির ভাগ লোকই আসে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও নরসিংদী, রূপগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ থেকে। এ ছাড়া স্থানীয় লোকজনও জুয়া খেলায় অংশগ্রহণ করে। মাদক ও জুয়ার স্পট থেকেও আদায় হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও রাজউকের কর্মকর্তাদের মাসোহারা দিয়েই দিন দিন বেপরোয়াভাবে চালানো হচ্ছে ‘নীলা মার্কেটের’ নামে নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড। পূর্বাচল নতুন শহরে স্টেডিয়ামের জমি দখল করে গড়ে ওঠা নীলা মার্কেট কয়েক দফা উচ্ছেদ করার পর আবারও দখল হয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নীলা মার্কেট আমরা কয়েকবার উচ্ছেদ করেছি। স্টেডিয়ামের জায়গা থেকেও উচ্ছেদ করা হয়েছে। তার পরও বার বার দখল হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘স্টেডিয়ামের জন্য যে জমি বরাদ্দ করা হয়েছে আমরা তা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দিয়েছি। কোরবানি ঈদের পরপরই পূর্বাচলে স্টেডিয়ামের জন্য বরাদ্দ দেওয়া জমি থেকে আমরা নীলা মার্কেটসহ সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে দলিলপত্রসহ ক্রিকেট বোর্ডকে বুঝিয়ে দেব। তারা জমি বুঝে পাওয়ার পর সীমানাপ্রাচীরসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবে। তখন আর জমি দখলের সুযোগ থাকবে না।’ যোগাযোগ করা হলে রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলা বলেন, ‘এমপি সাহেবের নির্দেশে পূর্বাচলের প্রস্তাবিত স্টেডিয়ামের জায়গায় এ অস্থায়ী বাজারটি বসানো হয়েছে। এখানকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন নিজেদের উৎপাদিত ফল-ফসল এ বাজারে বেচাকেনা করে জীবিকা নির্বাহ করেন।’ এ বাজার ঘিরে কোনোরকম চাঁদাবাজির কথা তিনি অস্বীকার করেন।

সর্বশেষ খবর