বুধবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

থমকে আছে আরও ২৪ হত্যার বিচার

আরাফাত মুন্না

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দিন সকালে খুনিদের ছোড়া কামানের গোলা গিয়ে পড়ে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের বস্তিতে। গোলার আঘাতে নিহত হন ১৩ জন। প্রায় ১ যুগ আগে অভিযোগ গঠন করা হলেও শেষ হয়নি এ মামলার বিচার কাজ। সেই কাল রাতে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িতেও হামলা চালায় বিপথগামী সেনারা। হত্যা করা হয় অন্তত আরও ১০ জনকে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হলেও থমকে আছে ২৩ জন বিচার। ঢাকার আদালতে বিচারাধীন থাকা পৃথক এই তিন হত্যা মামলার বিচার কবে শেষ হবে, এ প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এসব মামলার অধিকাংশ আসামিই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাজা পেয়েছে। অনেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এখন যারা বাকি আছে তাদেরও বিচার হবে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে বদ্ধপরিকর। কেউ যাতে বলতে না পারে বিচার পাইনি। আদালতে মামলা বিচারাধীন রয়েছে অর্থাৎ এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারও একদিন হবে।

মোহাম্মদপুরে কামান হামলা মামলা: এখন থেকে ৪৩ বছর আগে হত্যাকাণ্ডের এ ঘটনায় মামলা হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময় সেনারা কামানের গোলা ছুড়লে তা গিয়ে পড়ে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের ৮, ৯, ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (টিনশেড বসিত্ম) ওপর। লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) ছোড়া কামানের গোলার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মুহুর্তেই ল্লভ্ল হয়ে যায় ওই বসিত্ম। ওই ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ১৩ জন মারা যান। প্রায় ৪০ জন আহত হন। ওই ঘটনায় ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় এ মামলাটি করেন। ২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত্ম বিভাগ (সিআইডি) আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়। এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে আদালত। ১৭ আসামির মধ্যে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এছাড়া মামলার বাকি ১২ আসামি পলাতক রয়েছে। মামলার বাদী মোহাম্মদ আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি তখন ২৪ বছরের যুবক। মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের ৮ নম্বর বাড়িটি আমার ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন সকাল সাড়ে ৫ টায় বাসার ওপর কামানের গোলা এসে পড়ে। সেখানে বাসার ভাড়াটিয়া ও আমার গ্রামের লোকজন অবস্থান করছিল। কামানের গোলায় আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় রিজিয়া বেগমসহ ১৩ জন সেখানে মারা যান এবং প্রায় ৪০ জন আহত হন। আহতদের তাত্ক্ষণিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। তিনি বলেন, এ ঘটনায় মামলা করতে গেলে তৎকালীন মোহাম্মদপুর থানার ওসি রব দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অজুহাতে মামলা না নিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দেন। আর কামানের গোলায় নিহত লাশগুলোকে কবর দিতে বলেন। পরে ১৫ আগস্ট যা কিছু হয়েছে এ ব্যাপারে কোনো মামলা করা যাবে না- এ সংক্রান্ত্ম আইন পাস হয়। ফলে চেষ্টা করেও ওই সময় আর মামলা করা সম্ভব হয়নি। পরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এলে ওই কালো আইন বাতিল হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে সশরীরে মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে মামলা করেছিলাম। এই দীর্ঘ সময়েও মামলার বিচার শেষ না হওয়ায়ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। আদালতের নথিপত্র সূত্রে জানা গেছে, মামলার মোট ৫৮ সাড়্গীর মধ্যে এখনো পর্যন্ত বাদীসহ ১৫ জনের সাড়্গ্যগ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। সমন দিয়ে, এমনকি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেও সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা যাচ্ছেন বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। পরবর্তী সাড়্গ্যগ্রহণের জন্য আগামি ৪ অক্টোবর দিন ধার্য রয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ঢাকার চার নম্বর অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হেলাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বারবার সমন পাঠানোর পরও মামলার অনেক গুরম্নত্বপূর্ণ সাক্ষী সাড়্গ্য দিতে আসেননা।

সেরনিয়াবাত হত্যা মামলা : পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি তৎকালীন পানি ও বন্যানিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হামলা চালায় সেনারা। বাসার সব সদস্যকে ড্রয়িংরুমে জড়ো করে। এক পর্যায়ে ব্রাশফায়ার করে আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ ৮ জনকে হত্যা করে ঘাতকরা।

এ ঘটনায় ১৯৯৬ সালের ২১ অক্টোবর আবুল হাসানাতের স্ত্রী সাহান আরা বেগম বাদী হয়ে ঢাকার রমনা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তাসহ ১৬ জনের বিরম্নদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। বর্তমানে হাই কোর্টের আদেশে মামলার বিচারকাজ স্থগিত আছে। তবে মূল মামলাটি বতর্মানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। এ বিষয়ে ওই আদালতের প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার দুলাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে মামলাটি এখনও মুলতবি আছে। তাই বিচারকাজ এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না।’

শেখ মনি হত্যা মামলা : ২৫ থেকে ৩০ জনের একটি ঘাতক দল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শেখ ফজলুল হক মনির ধানমন্ডির ১৩/১-এর বাসায় আক্রমণ চালায়। তারা খুন করে শেখ মনি ও তার অন্ত্মঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকে। ১৯৯৬ সালের ২০ নভেম্বর ধানমন্ডির থানায় ১৮ জনকে আসামি করে মামলা হলেও নথি না পাওয়ায় মামলার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না বলেই জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র।

সর্বশেষ খবর