শুক্রবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা

ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম (অব.)

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম (অব.) এমপি বলেছেন, বাংলাদেশ নামের একটা রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দক্ষ, অসম সাহসী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে। তিনি বাঙালি জাতিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে রুখতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। ক্যাপ্টেন তাজ বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হন ’৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডন যান, তারপর দিল্লি হয়ে ’৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেন। মূলত বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের কার্যক্রম গ্রহণ করেন। ১০ মাসের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সংবিধান প্রণয়ন, মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সেনাদের দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানো, নতুন প্রজাতন্ত্রের জন্য বিশ্বের ১৩০টি দেশের স্বীকৃতি লাভ, ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত ১ কোটি মানুষ এবং যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা-রাজাকার-আলবদর-আলশামস সদস্যদের দ্বারা ধর্ষিত প্রায় ৩ লাখ নারীর পুনর্বাসন বঙ্গবন্ধু সরকারের ঐতিহাসিক সাফল্য। কিন্তু দেশি-বিদেশি চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ‘স্বপ্নের সোনার বাংলা’ রচনার এ অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করে দেয়। ষাটের দশক থেকে যারা ধারাবাহিকভাবে আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে এসেছে, পনের আগস্টের পর সেসব অপশক্তি ক্ষমতা দখল করে। ফলে ’৭৫-এর পর বাংলাদেশ পথ হারিয়ে ফেলে।

বাঙালি জাতির সেই জঘন্য কালো অধ্যায়ের স্মৃতিচারণা করে এ বি তাজুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল পরিকল্পক হিসেবে আমরা যাকে জানি সেই কর্নেল রশীদ ভারতে থেকে ট্রেনিং নিয়ে সেনা সদরে যোগদান করে। তাকে যশোরে পোস্টিং দেওয়া হলেও কোনো অদৃশ্য কারণে তার পোস্টিং বাতিল হয় এবং সে ঢাকায় সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারিতে যোগদান করে। ট্যাংক রেজিমেন্টে প্রস্তুত রাখা হয় মেজর ফারুককে। অন্যদিকে রক্ষীবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানকে একটি সামরিক অনুষ্ঠানে পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগদানের জন্য আমেরিকায় পাঠানো হয় এবং তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ডকে রাখা হয় ঢাকার বাইরে। এভাবেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নীলনকশা প্রণীত হয় এবং সংঘটিত হয় ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল পরিকল্পনা সম্পর্কে জিয়াউর রহমান সম্যক অবগত ছিলেন এবং পর্দার অন্তরাল থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যায় তিনি কলকাঠি নেড়েছেন— এ কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যায় মূলত ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সার ও টু ফিল্ড আর্টিলারি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে মেজর আবদুর রশিদ টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন যা ৪৬ ব্রিগেডের অধীন ও ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সার রেজিমেন্ট হেডকোয়ার্টারের অধীন ছিল। বিস্ময়করভাবে জাতির জনক হত্যার কয়েক মাস আগে ৪৬ ব্রিগেড থেকে ফিল্ড ইনটেলিজেন্স সরিয়ে নেওয়া হয় এবং ওই ইনটেলিজেন্সকে সেনা সদরের অধীন করা হয়। ফলে ঢাকায় সার্বিক চিত্র সম্পর্কে কোনো তথ্য, ঘটনা ৪৬ ব্রিগেডের কাছে পৌঁছাত না। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে ক্যাপ্টেন তাজ বলেন, ’৭৫ সালের ১৪ আগস্ট কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রেনিংয়ের নামে বের হয় ট্যাংক টি-৫৪ এবং কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অবস্থান করতে থাকে। সেখানে কর্নেল ফারুক তার সঙ্গীদের বুঝিয়ে দেয় সব পরিকল্পনা। টার্গেট ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়ক, বঙ্গবন্ধুর বাসভবন। ২৭ নম্বর রোড, সোবহানবাগ মসজিদ আর ৩২ নম্বর রোডে তৈরি করা হয় রোড ব্লক; নেওয়া হয় বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা। আর রক্ষীবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে ট্যাংক নিয়ে প্রস্তুত থাকে মেজর ফারুক নিজেই। ভোর ৪টায় বাঙালি যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ঠিক তখনই বাঙালি জাতির সর্বকালের মহানায়কের বাসভবনে চলে ইতিহাসের জঘন্যতম আক্রমণ এবং সপরিবারে বঙ্গবন্ধুসহ হত্যা করা হয় ১৭ জন সদস্যকে। এ হত্যাকাণ্ড বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ষড়যন্ত্রের বিষয়ে ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল বলেন, বাঙালির স্বাধিকার-স্বাধীনতা প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু আপসহীন ছিলেন এবং এ কারণে তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ কেটেছে কারাগারে। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ে তোলা। জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে একটি অপশক্তি চেয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ হোক এবং বাংলাদেশ একটি ‘অকার্যকর রাষ্ট্র’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করুক। কিন্তু সব চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে অদম্য গতিতে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে উদার-অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বমঞ্চে সম্মানের আসনে আসীন হয়েছে বাংলাদেশ। ঘাতকচক্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করলেও তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে সেই স্বপ্ন ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমরা সুনিশ্চিত বিজয়ের পথে।

সর্বশেষ খবর