শনিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

হুন্ডিতেই হয় যত সর্বনাশ

নির্বাচনের আগে পাচারের মাত্রা আরও বাড়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক

মানিক মুনতাসির

অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় হুন্ডির মাত্রা বেড়েছে। অবৈধ পথে দেশের টাকা বিদেশে পাঠিয়ে মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছেন এক ধরনের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এর মাত্রা আরও বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে বিশ্বের প্রভাবশালী অর্থ-বাণিজ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন ফোর্বসের করা সিঙ্গাপুরের শ্রেষ্ঠ ধনীর তালিকায় বাংলাদেশের এক ব্যবসায়ীর নাম উঠে এসেছে ৩৪তম অবস্থানে। এ ছাড়া ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিনানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআইইউ) প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যমতে, মুদ্রা পাচারকারী ১০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০তম। যদিও এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ কিছুটা কমেছে, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ কমলেও অর্থ পাচারের পরিমাণ কমেনি। পাশাপাশি বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রকাশিক সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে সন্দেহজনক বা অস্বাভাবিক লেনদেন ও তৎপরতা বৃদ্ধির তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আর্থিক খাতে সন্দেহজনক ২ হাজার ৩৫৭টি লেনদেন ও তৎপরতার তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ ধরনের লেনদেনের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬৮৭। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৩৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। এসব লেনদেন দেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনে করে বিএফআইইউ।

হুন্ডির টাকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হোটেল, মোটেল, বাড়ি, ক্রয় করছেন পাচারকারীরা। বাংলাদেশ থেকে অন্য কোনো দেশে বিনিয়োগের আইনি কোনো বিধান না থাকলেও তারা হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন অন্য দেশে। আর তা বিনিয়োগও করছেন। পাশাপাশি সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রাখছেন। অবশ্য সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশি নাগরিকদের জমানো অর্থের পরিমাণ গত এক বছরের ব্যবধানে ২৭ শতাংশের মতো কমেছে। ২৮ জুন ২০১৭ সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৭ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের জমার পরিমাণ কমে ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঁতে নেমেছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। আগের বছর ২০১৬ সালে এর পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ (৫ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা)। সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ কমলেও প্রকৃতপক্ষে অর্থ পাচারের পরিমাণ কমেনি। বরং অন্য কোনো দেশকে নিরাপদ মনে করে সে দেশের ব্যাংকে বাংলাদেশিরা নিজেদের পাচার করা অর্থ গচ্ছিত রাখছেন কি না সে ব্যাপারে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশাল বাংলাদেশের (টিআইবির) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তার মতে, অর্থ পাচারের পরিমাণ মোটেই কমেনি। বরং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ বছর আরও বাড়বে। তবে সুইস ব্যাংকের বাইরে অন্য কোথাও অর্থ যাচ্ছে কি না তা এখন দেখা প্রয়োজন। এসএনবির প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সুইস ব্যাংকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশি নাগরিকদের জমার পরিমাণ ছিল ৫৫ কোটি ৮ লাখ সুইস ফ্রাঁ। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৩ সাল থেকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত বাড়তে থাকলেও ২০১৭ সালে এসে এটি কিছুটা কমে গেছে। ২৯ জুন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছিলেন, সুইস ব্যাংকগুলোতে শুধু ব্যক্তি আমানতই নয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্থও লেনদেন হয়। বিশ্বব্যাপী মানি লন্ডারিং আইনের কড়াকড়িতে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো আগের মতো গ্রাহকদের তথ্য গোপন রাখতে পারছে না। সে কারণেও গ্রাহকরা আমানত কমিয়ে আনতে পারেন। এর মানে এটা প্রমাণ হয় না যে, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার কমছে। আমদানি-রপ্তানিসহ অর্থনীতির বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আগের চেয়ে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়েছে। পাচারকৃত এই অর্থ সুইস ব্যাংকে জমা না হলেও বিভিন্ন দেশে সম্পত্তি ক্রয়ে বিনিয়োগ হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। জিএফআইর তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। আর বাংলাদেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, এর পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ফলে দিনে দিনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে এই হুন্ডি। বিষয়টি নিয়ে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে হুন্ডি রোধের পথ খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হুন্ডির সঙ্গে যোগসাজশ থাকায় সরকার এ ব্যাপারে তাত্ক্ষণিক কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, কালো টাকার উৎপত্তি ঠেকানো না গেলে পাচার ঠেকানো যাবে না। আর সুইস ব্যাংক তো কাউকে তথ্য দিতে বাধ্য নয়। ফলে তারা তথ্য না দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুই করতে পারবে না বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অর্থ পাচারের একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে টাকা দেশে ব্যবহার হচ্ছে না বা বিনিয়োগ হচ্ছে না। কিন্তু বিনিয়োগ হলেও টাকা পাচার হবে। কেননা পাচারকৃত অর্থের বেশির ভাগই কালো টাকা। এই টাকা দেশে বিনিয়োগ বা ঘোষণা দিতে এক ধরনের ভয় কাজ করে। ফলে তা পাচার করে দেওয়া হয়। পাচার ঠেকাতে হলে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ ফিনানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী চক্রের সঙ্গে যারা যুক্ত বিশ্ব জুয়ার আসরে বাংলাদেশের টাকা ওড়াচ্ছেন, তাদের ব্যাপারেও খোঁজখবর নিচ্ছে বিএফআইইউ। এ জন্য বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে বিএফআইইউ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্যহীনতায় পুঁজি পাচার হচ্ছে। দেশে সঞ্চয় বাড়ছে, কিন্তু বিনিয়োগ বাড়ছে না। ওই টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নানাভাবে টাকা পাচার হচ্ছে। পণ্য আমদানির নামে ঋণপত্রের মাধ্যমে। কম দামে কম পণ্য এনে দেনা শোধ করা হচ্ছে বেশি দাম বা বেশি পণ্য দেখিয়ে। রপ্তানিপণ্যের একটি অংশের মূল্য দেশে আসছে না। ওই টাকাও পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। নগদ ডলার বা স্বর্ণের মাধ্যমেও দেশ থেকে টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশে। এ ছাড়া চিকিৎসা ব্যয়, বিদেশ ভ্রমণ, লেখাপড়ার খরচ এসব মাধ্যমেও টাকা পাচার হচ্ছে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমেও টাকা পাচারের ঘটনা ধরা পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচারের ঘটনা আবিষ্কৃত হয়েছে বলে জানা গেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর