শনিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

নওগাঁয় ১০৮ কক্ষের মাটির বাড়ি

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

নওগাঁয় ১০৮ কক্ষের মাটির বাড়ি

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য মাটির বাড়ি। গ্রামের মানুষের কাছে গরিবের এসি হিসেবে খ্যাত। মাটির বাড়ি শীত ও গরমের সময় বেশ আরামদায়ক। এক সময় গ্রামের বিত্তশালীরাও অনেক অর্থ ব্যয় করে মাটির দোতলা বাড়ি তৈরি করতেন। তবে ইট, বালি ও সিমেন্টের আধুনিকতায় মাটির বাড়ি এখন প্রায় বিলীনের পথে। এমন এক বাড়ি রয়েছে নওগাঁর মহাদেবপুরের আলিপুর গ্রামে। ১০৮ কক্ষের মাটির বাড়িটি ১৯৮৬ সালে তৈরি। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে চেরাগপুর ইউনিয়নের আলিপুর গ্রামে। জেলা সদর থেকে মহাদেবপুর আসার পথে আন্তজেলা মহাসড়কের তেরমাইল নামক মোড় থেকে উত্তর দিকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে পাকা রাস্তার পাশে রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িটি অবস্থিত। যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারলে বাড়িটি হয়ে উঠতে পারে গ্রাম বাংলার একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। বাড়িটি ৩ বিঘা জমির ওপর নির্মিত। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০০ ফিট। প্রস্থ ১০০ ফিট। বাড়িতে ছাউনির জন্য টিন লেগেছে ২০০ বান্ডিল। মাটির এই বাড়িটি দেখতে অনেকটা প্রাসাদের মতো। বিশাল এই বাড়িটির নির্মাতা দুই সহোদর সমশের আলী মণ্ডল ও তাহের আলী মণ্ডল। আলিপুর গ্রামের আসমত আলী (৬০) বলেন, মাটি, খড় ও পানি ভিজিয়ে কাদায় পরিণত করে ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হয়। এ দেয়াল তৈরিতে বেশ সময় লাগে। কারণ একসঙ্গে বেশি উঁচু করে মাটির দেয়াল তৈরি করা যায় না। প্রতিবার এক থেকে দেড় ফুট উঁচু করে দেয়াল তৈরি করা হয়। কয়েকদিন পর শুকিয়ে গেলে আবার তার ওপর একই উচ্চতার দেয়াল তৈরি করা হয়। এভাবে দোতলা বাড়িটির ২০-২২ ফুট উঁচু নির্মিত হয়েছে। ওই গ্রামের আরেক বৃদ্ধ লয়খত আলী বলেন, বাড়িটির সৌন্দর্য বাড়াতে চুন ও আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে মাটির দোতলা বাড়ি নির্মাণ করতে ৯ মাস সময় লাগে। তবে এই বাড়িটি সম্পন্ন করতে সময় লেগেছিল প্রায় এক বছর। বাড়িসহ আশেপাশের মোট ২১ বিঘা জমি রয়েছে। আর ওই বাড়িটি তৈরি করতে একটি বিশাল পুকুর খনন করতে হয়েছে। একই দোকান থেকে ২০০ বান্ডিল টিন কিনেছিল বাড়িওয়ালারা। এজন্য দোকানদার তাদের একটি চায়না ফনিক্স বাইসাইকেল উপহার দেন। টিন সংগ্রহ করতে দোকানির সময় নিয়েছিল সাত দিন। এ বিষয়ে সমশের আলী মণ্ডলের স্ত্রী ফাতেমা বলেন, হেঁটে বাড়ির চার ধার চক্কর দিতে সময় লাগে ৬-৮ মিনিট। ১০৮ কক্ষের এই বাড়িতে প্রবেশের দরজা ৭টি। প্রতিটি ঘরে রয়েছে একাধিক দরজা। দোতলায় উঠার সিঁড়ি রয়েছে ১৮টি। যে কোনো একটি দরজা দিয়ে যাওয়া যাবে ১০৮ কক্ষেই। ৯৬টি বড় ১২টি ছোট কক্ষ রয়েছে। বাড়িতে বর্তমানে  ৩৬জন লোক বসবাস করে।  সমশের আলী মণ্ডল ও তাহের আলী মণ্ডল দুই ভাই শখের বসে বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। বাড়িটি নির্মাণে শতাধিক কারিগর লেগেছিল। যে পরিমাণ মাটি লেগেছিল তা বাড়ির পেছন থেকে নেওয়া হয়। সেখানে একটি পুকুর তৈরি হয়েছে। সমশের আলী মণ্ডলের ছেলে ফারুক হোসেন বলেন, বর্তমানে বাড়িটিতে বড় চাচি ফাতেমা, তার ৪ ছেলে, আমরা দুই ভাই ও স্ত্রী, আর ফুফু মাজেদার ২ ছেলে আছি। এ ছাড়া তাদের স্বামী-স্ত্রী-সন্তান, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি, আত্মীয়-স্বজনসহ মোট ৩৬জন বসবাস করছেন। তবে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারলে বাড়িটি হয়ে উঠতে পারে গ্রাম বাংলার একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। তাহের মণ্ডলের ছেলে মাসুদ রানা বলেন, ১০ বছর আগে বড় চাচা সমশের আলী ও বাবা তাহের আলী ৪ বছর আগে মারা গেছেন। আমার জানা মতে সমগ্র বাংলাদেশে ১০৮ কক্ষের মাটির বাড়ি নেই। শুধু নওগাঁর মহাদেবপুরে রয়েছে। আমার বাবা ও চাচা শখের বসে বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে এ বাড়িটি দেখার জন্য লোক আসে। এ বিষয়ে চেরাগপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শিবনাথ মিত্র  বলেন, এটি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। যা বাংলাদেশে আছে বলে মনে হয় না। বর্তমানে মাটির ঘরের স্থান দখল করে নিয়েছে ইট, সিমেন্ট, বালি ও রডের তৈরি পাকা ঘর। মাটির ঘরগুলো বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশেষ ক্ষতি সাধন হয় বলেই মানুষ ইট সিমেন্টের ঘর-বাড়ি নির্মাণে আগ্রহী হচ্ছেন। তবে গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক বাহক ও পর্যটকদের জন্য দৃষ্টিনন্দন দর্শনীয় স্থান আলিপুর গ্রাম।

সর্বশেষ খবর