শনিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

ঢাকায় দুর্ঘটনাপ্রবণ ৫৪ পয়েন্ট

বুয়েট-পিপিআরসির গবেষণা

জিন্নাতুন নূর

অব্যবস্থাপনা ও চালকদের বেপরোয়া যান চালনার ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রাণহানি ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা মহামারিতে রূপ নিয়েছে। সড়ক-মহাসড়কের মোড়ে মোড়ে যেন পাতা আছে মৃত্যুফাঁদ। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, শুধু রাজধানী ঢাকাতেই আছে ৫৪টি দুর্ঘটনাপ্রবণ পয়েন্ট। ঢাকা মহানগরীর বাইরে দেশের পাঁচ বিভাগ ও জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো হলো কুমিল্লা, ঢাকা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও চট্টগ্রাম। আর দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সড়ক-মহাসড়কে যথাযথ নির্দেশিকা ও গতিরোধক চিহ্ন না থাকা, সড়কজুড়ে অসংখ্য গর্ত, মহাসড়কে অসংখ্য মোড়, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালনা, ওভারটেকিং, পথচারীদের অসচেতনতাসহ বেশকিছু বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিবেদনমতে, বাংলাদেশে বছরে ৪ লাখ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয় এবং ১৮ হাজার ৫০০ মৃত্যুবরণ করে। এতে প্রতি বছর মোট জিডিপির ২ শতাংশ ক্ষতি হয়। ন্যাশনাল কমিটি টু প্রটেক্ট শিপিং রোডস অ্যান্ড রেলওয়েজের জরিপে ২০১৭ সালের শেষ ছয় মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ২৯৭ জনের মৃত্যু আর ৫ হাজার ৪৮০ জন আহত হয়। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট রাজধানীর বেশ কয়েকটি পয়েন্ট চিহ্নিত করেছে যেখানে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। এগুলো হচ্ছে যাত্রাবাড়ী, কাকলী, জসীমউদ্দীন রোড ক্রসিং, সায়েদাবাদ, ফার্মগেট, পান্থপথ ও জোয়ারসাহারা। অন্যদিকে মহাসড়কগুলোর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের ১৬.৫ কিলোমিটারের ৩১, ঢাকা-আরিচা হাইওয়ের ৮.৮ কিলোমিটারের ১৭, দৌলতদিয়া-ঝিনাইদহ-খুলনা হাইওয়ের ৫.৮ কিলোমিটারের ১২, নগরবাড়ী-বাংলাবান্ধা হাইওয়ের ৭.৯ কিলোমিটারের ২১, গাজীপুর-টাঙ্গাইল মহাসড়কের ২.৬ কিলোমিটারের ৭, নগরবাড়ী-রাজশাহী হাইওয়ের ৬.৪ কিলোমিটারের ১৫, ঢাকা-মাওয়া-বরিশাল মহাসড়কের ৪, যমুনা ব্রিজের ২.২ কিলোমিটারের ৫ ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ১৩টি পয়েন্ট দুর্ঘটনাপ্রবণ। গবেষণায় আরও বলা হয়, দেশের সড়ক দুর্ঘটনার ৫৪ শতাংশ দিনে ও ৩০ শতাংশ রাতে সংঘটিত হয়। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাকের ‘রোড সেইফটি ইন বাংলাদেশ গ্রাউন্ড রিয়েলিটিজ অ্যান্ড অ্যাকশন’ শীর্ষক জরিপে উল্লেখ করা হয়, সড়কে যথাযথ নির্দেশিকা ও গতিরোধক না থাকা, সড়কজুড়ে অসংখ্য গর্ত থাকায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া সড়কে অসংখ্য মোড়, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালনা, ওভারটেকিং, পথচারীদের অসচেতনতা এবং চালকদের ট্রাফিক আইন না মানা, ত্রুটিপূর্ণ যান ও ঘুমন্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে মহাসড়কগুলোয় প্রধান সড়কের ওপর কিছু দূর পরপর বাজার ও বাসস্ট্যান্ড থাকায় দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে যত্রতত্র বাসস্ট্যান্ডের কারণে ৪০.৯০ এবং বাজারের কারণে ২৮.৪০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। আর সড়কের মোড়ের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে ১৭.৮০ শতাংশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল চালক, পথচারী ও গণপরিবহনের যাত্রীরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। আর বেপরোয়া বাসচালকদের কারণে ৩৮.১, ট্রাকচালকদের দ্রুত গতিতে চালনার কারণে ৩০.৪, মোটরসাইকেল চালকের কারণে ১২, প্রাইভেট কার চালকদের কারণে ১০.৫ ও থ্রি-হুইলারের কারণে ৯ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। ৪২ শতাংশ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে চালকরা দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তি বা বাহনকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি না থামিয়েই চলে যান আর ১৯ শতাংশ ক্ষেত্রে যানবাহনগুলোর মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য গাড়িচালকদের দায়ী করা হলেও এর কারণ অনুসন্ধানে এই গবেষণায় রাজধানীর পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বাসস্ট্যান্ডের ১০২ জন বাসচালকের সঙ্গে কথা বলা হয়। তারা জানান, তাদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ গাড়ি চালানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন আর ৮১ শতাংশই তাদের আত্মীয় বা বন্ধুদের কাছ থেকে গাড়ি চালানো শিখেছেন। চালকরা পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ না পেয়ে সপ্তাহজুড়ে প্রতিদিনই টানা ১৩ থেকে ১৬ ঘণ্টা পরিশ্রম করেন। আবার এই চালকদের ৪২.২ শতাংশই গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন; যা দুর্ঘটনার আশঙ্কা বৃদ্ধি করে। রাজধানীর বাসচালকদের তুলনায় দূরপাল্লার বাসচালকরা বেশি দুর্ঘটনা ঘটান। এর পরই মহাসড়কে চলাচলকারী মিনিবাস ও ট্রাকচালকরা দুর্ঘটনা বেশি ঘটান। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মহাসড়কগুলোর দুই পাশে বাজার, দোকানপাট ও অর্থনৈতিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া নসিমন, করিমন ও ইজিবাইকের মতো যানগুলোর মাধ্যমে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহাসড়ক তৈরির সময় সড়কের পাশে কিছুটা নিচে ছোট যান চলাচলের জন্য আলাদা পথ তৈরি করতে হবে। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা কমে যাবে।’

সর্বশেষ খবর