রবিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

মোটাতাজা কোরবানির পশুতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

মোটাতাজা কোরবানির পশুতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি

ঈদুল আজহা সমাগত। মুসলমানদের পবিত্র কোরবানির ঈদ। বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অন্যতম প্রিয় ধর্মীয় উৎসব। এই বিশেষ দিনে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিভিন্ন ধরনের গবাদি পশু কোরবানি করা হয়। হাদিসে মোটাতাজা, সুস্থ, সুন্দর পশু কোরবানি করতে বলা হয়েছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এতে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই মোটাতাজা গরু কোরবানি করতে উৎসাহিত হবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ কথা সর্বজনবিদিত, ঈদের আগে অধিক মুনাফার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অনৈতিক পন্থায় গরু মোটাতাজা করা হয়। বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে বা ট্যাবলেট খাইয়ে পশু মোটাতাজাকরণ অত্যন্ত গর্হিত কাজ, যা আদৌ শরিয়তসম্মত নয়। এর মাধ্যমে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণাই করা হয়। কারণ, কোরবানির অন্যতম শর্ত সুস্থ ও সবল গরু। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি ধোঁকা দেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। প্রতারণা করা ও ধোঁকা দেওয়ার কারণে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ ইবনে হ্বিবান, মুসলিম, সহিহাহ। অনৈতিক পন্থায় না গিয়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক উপায়ে গরুর স্বাস্থ্য বৃদ্ধি করা যায়। সাধারণত পশুকে প্রাকৃতিক উপায়ে মোটাতাজা ও সুস্থ রাখতে খড়, তাজা ঘাস, খৈল, ভুসিসহ পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হয়। এ নিয়ম বিজ্ঞানসম্মত। যুগ যুগ ধরে তাই অনুসৃত হয়ে আসছে। এ নিয়মে পশু মোটাতাজা করা হলে ক্রেতা একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, একই সঙ্গে এ ধরনের পশুর মাংস খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকিও থাকে না। মাংস ব্যবসায়ীদের মতে, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে প্রতি বছরই কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজাকরণের ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে ওঠে একশ্রেণির খামারি। ঈদের কিছুদিন আগে রোগাক্রান্ত ও শীর্ণকায় গরু অল্প টাকায় কিনে অধিক হারে মুনাফা লাভের আশায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী স্টেরয়েড বড়ি, ইউরিয়া, নিষিদ্ধ পাম বড়িসহ বিভিন্ন ওষুধ খাওয়ানোর ও স্টেরয়েড ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে গরু মোটাতাজা করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। উদ্দেশ্য একটাই— গরুকে দ্রুত মোটাতাজা করানো। মোটা মানেই বেশি গোশত, বেশি লাভ। এসবের ব্যবহারে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই গরুর ওজন বেড়ে যায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গরুর শরীরে কোনো মাংস বৃদ্ধি হয় না। অথচ স্টেরয়েড ওষুধ ব্যবহারের অনেক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে। মানুষের বেলায় যেমন দীর্ঘদিন স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ ব্যবহারে দীর্ঘমেয়াদি পারিপার্শ্বিক ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তেমনি পশুর ক্ষেত্রেও একই আশঙ্কা থেকে যায়। গরু মোটাতাজাকরণের জন্য অনেক উচ্চমাত্রায় স্টেরয়েড খাওয়ানো হয়। এতে প্রাণীটির স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, ভাষাহীন, প্রতিবাদহীন অবুঝ পশুগুলো এভাবে বিবেকহীন মানুষের কাছে হয়ে পড়ে অসহায়। আর এ ধরনের পশুর মাংস খাওয়াও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর।

স্টেরয়েড ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে গরুর দেহ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। তার দেহের চর্বির কোষগুলো বাড়ে। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় পশুর হৃৎপিণ্ড, কিডনি ও যকৃৎ, কমে যায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। অনেক সময় এসব ওষুধ সেবনে পশু হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারাও যেতে পারে। এ-জাতীয় গরুর গোশতে অধিক পরিমাণ চর্বি বা কলেস্টেরল থাকে, যা নিয়মিত গ্রহণ করলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধমনি চিকন হয়ে হৃদরোগ এমনকি ব্রেন স্ট্রোকও হতে পারে। শরীরের ওজন বাড়ে, ফলে এ ধরনের জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায়। স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা পশুর গোশত হয়তো দু-এক দিন খেলে কিছু হবে না। কিন্তু নিয়মিত খেলে, কিংবা অভ্যাসে পরিণত হলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং মানুষের ক্ষতির আশঙ্কা বেশি থাকে। কোরবানির সময় মানুষ বেশি বেশি গোশত খায়। অনেকে মনে করেন কোরবানির পশুর গোশত খেলে কোনো ক্ষতি হয় না, যা একেবারে ভুল ধারণা। কোরবানির সময় আমরা প্রচুর রোগী পাই, বিভিন্ন হাসপাতালেও রোগীর সংখ্যা বাড়ে। বেশি গোশত খেয়ে পেটের পীড়া, হৃদরোগ এমনকি স্ট্রোক হয়ে প্রচুর রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। আজকাল নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যে প্রচুর ভেজাল দেওয়া হচ্ছে, যা খেয়ে মানুষের হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সারসহ অনেক রোগ বেড়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন ভেজাল স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ প্রয়োগকৃত গরুর গোশত। এ ক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতারও অভাব রয়েছে। সুস্থ থাকার জন্য রেড মিট ত্যাগ করতে হবে অথবা কম খেতে হবে। নিয়মিত প্রচুর গোশত খাওয়া অনুচিত। কেবল গরুই নয়, মহিষ ও খাসির গোশতেও প্রচুর চর্বি থাকে। সেগুলোও ত্যাগ করতে হবে। চর্বি-জাতীয় খাদ্য যত পরিত্যাগ করা যাবে, ততই শরীর সুস্থ ও সবল থাকবে।

আসুন জেনে নিই ক্ষতিকারক ওষুধ খাওয়ানো মোটাতাজা গরু চেনার উপায় : * অতিরিক্ত স্টেরয়েড ট্যাবলেট খাওয়ানো বা ইনজেকশন দেওয়া গরুর পুরো শরীরে পানি জমে মোটা, নাদুসনুদুস দেখাবে। পেট বেশি বড় মনে হবে, বুক থেকে নিচের দিকে নেমে থাকবে, বেলুনের মতো মনে হবে। * এসব গরুর পেছনের দিকে ঊরুর পেশিবহুল জায়গায় আঙুল দিয়ে চাপ দিলে তা দেবে গর্তের মতো হবে এবং আঙুল সরিয়ে নেওয়ার পরও কিছুক্ষণ তা বিদ্যমান থাকবে। বাইরে থেকে মাংস মনে হলেও এখানে মাংসের মধ্যে ব্যাপক পরিমাণ পানি থাকে। পশুর ঊরু অনেক মাংসল মনে হবে। পাগুলো মনে হবে অনেক পাতলা বা শুকনো। * স্টেরয়েড খাওয়ানোর ফলে গরু অস্বাভাবিক মোটা হয়। কিন্তু দুর্বল ও অসুস্থতার কারণে সব সময় নীরব ও নির্জীব থাকে, নড়াচড়া কম করে, অলস প্রকৃতির হয়, কম আওয়াজ করে, ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না, কম শক্তিশালী হয়। এমনকি খাবারও খেতে চায় না, তাকে আঘাত করলেও নড়াচড়া করতে চায় না। * অন্যদিকে প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মোটাতাজাকৃত গরুর স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। মাথা উঁচু, কান খাড়া, শরীর টানটান, তীক্ষ থাকবে। গরুগুলোর প্রাণোচ্ছল ও প্রাণচাঞ্চল্যপূর্ণ চটপটে ভাব থাকবে, দ্রুত হাঁটাচলা ও স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া করবে। ভারি আওয়াজে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকবে, এমনকি গুঁতো দিতেও উদ্যত হবে। অনেক উচ্চাভিলাষী মানুষের মাঝে একটা প্রতিযোগিতার ভাব থাকে, কে কত বড়, কত দামি গরু কোরবানি দিতে পারেন। অনেকেই আবার বড় আকৃতির মোটাতাজা গরু কিনে কোরবানিকে ভোগের উৎসব ও প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় পরিণত করেছেন। কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তা সম্পূর্ণ অনুচিত। কারণ কোরবানির অর্থই হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ স্বীকার করা। অহংকার, অনাচার ও আত্মম্ভরিতা বর্জনই স্রষ্টার নির্দেশিত কোরবানির শিক্ষা। তাই কোরবানির পশু নির্বাচনের সময় মোটাতাজা গরু কেনার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী, কম মোটা, সুন্দর শারীরিক গঠন ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর পশুই কেনা উচিত। বেশি দামি গরু না কিনে কয়েকটা গরু কোরবানি দেওয়াও ভালো। প্রশাসনের উচিত পশুর হাটগুলোয় তদারকি করে স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ প্রয়োগে মোটা করা পশু চিহ্নিত করা। চিকিৎসকরা যেমন দীর্ঘমেয়াদি স্টেরয়েড গ্রহণকারী রোগী দেখেই চিনতে পারেন, তেমন অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকও এ ধরনের স্টেরয়েড খাওয়ানো পশু দেখেই শনাক্ত করতে পারবেন। অনৈতিকভাবে স্টেরয়েড বা হরমোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা অবশ্যই নেওয়া উচিত, এমনকি শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। মৎস্য ও পশুসম্পদ আইনে (২০১০) স্পষ্ট উল্লেখ আছে, পশুকে অ্যান্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন বা ক্ষতিকর স্টেরয়েড খাওয়ানো যাবে না। আর জনগণের মনে রাখা উচিত, খুব সুন্দর মোটাতাজা গরুর প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে সুস্থ স্বাভাবিক এমনকি কম মোটা বা ছোট, শুকনা গরু কোরবানি করা ও তার গোশত খাওয়া অনেক নিরাপদ।

লেখক : অধ্যাপক ও ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর