সোমবার, ২০ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিড়ম্বনা নিয়েই ঘরে ফেরা

ঠাঁই নেই বাস লঞ্চ ট্রেনে, যানজটে বিভিন্ন স্থানে আটকা পড়েছে গরুবাহী গাড়ি

সাঈদুর রহমান রিমন

বিড়ম্বনা নিয়েই ঘরে ফেরা

অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায় অধিকাংশ লঞ্চ। বিমানবন্দর স্টেশনে ট্রেনের ছাদেও ঠাঁই নেই —রোহেত রাজীব ও জয়ীতা রায়

ঈদযাত্রায় শিডিউল বিপর্যয়ের ফাঁদে পড়েছে কমলাপুর রেলস্টেশন। ঈদযাত্রার তৃতীয় দিন গতকাল অধিকাংশ ট্রেনই নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কয়েক ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে যায়। স্টেশনে ট্রেন আসছেও দেরিতে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। সকাল থেকেই কমলাপুর রেলস্টেশনে যাত্রী উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এদিকে ঘাটে ঘাটে গরুবাহী ট্রাকগুলো চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। নির্ধারিত চাঁদা না দিলে সিরিয়াল মিলছে না। আগে যেখানে সিরিয়াল পাওয়ার জন্য ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা দিতে হতো, এবার সেখানে পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার টাকা দিয়ে তবেই মিলছে সিরিয়াল। এ চাঁদা শুধু এক জায়গায় নয়, দিতে হচ্ছে বিভিন্ন ফেরিঘাটে। এদিকে গতকাল কমলাপুর রেলস্টেশনের আঙিনা, প্লাটফর্ম ও আশপাশের জায়গায় তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। গতকাল সকাল থেকেই এখানে ভিড় করেন বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা। নাড়ির টানে বাড়ি ফিরতে রীতিমতো যুদ্ধ করেন তারা। ট্রেন প্লাটফর্মে দাঁড়াতেই তাতে আগে ওঠার প্রতিযোগিতায় রীতিমতো হুড়োহুড়ি চলে। অনেকেই চড়েছেন ট্রেনের ছাদে। শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না ঘরমুখো মানুষ। তবে অতিরিক্ত যাত্রীচাপ সামাল দেওয়ার পাশাপাশি ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় লাঘবে তৎপর থাকার কথা জানায় কর্তৃপক্ষ। মহাসড়কে যানজট কম থাকায় এবং তুলনামূলক কম যাত্রীর চাপের কারণে কিছুটা স্বস্তি নিয়েই বাড়ি ফিরছেন সড়কপথের যাত্রীরা। তবে পশুবাহী ট্রাকের কারণে মহাসড়কে যান চলাচলে কিছুটা ধীরগতি রয়েছে। দেরিতে ঢাকায় পৌঁছাচ্ছে বেশির ভাগ বাস। তবে মহাসড়কের পরিস্থিতি ভালো বলে দাবি করলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী। ফেরি পারাপারে পশুবাহী গাড়িকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় যাত্রী পরিবহনে সময় বেশি লাগছে বলেও স্বীকার করেন তিনি। বাড়তি ভাড়া আদায় রোধে বাস টার্মিনালে ভিজিলেন্স টিম কাজ করছে। এবার ঈদযাত্রায় আড়াই হাজারের বেশি বাস চলছে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে এমন তথ্য জানিয়েছে পরিবহন মালিক সমিতি। এদিকে সকালে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল পরিদর্শন করে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ‘লঞ্চগুলোতে অতিরিক্ত যাত্রী বহন এবং নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া ঠেকাতে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ নৌপরিবহন-সংশ্লিষ্ট সবাইকে ঘাটে সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখারও নির্দেশ দেন মন্ত্রী। কমলাপুর স্টেশন এলাকায় সরেজমিন গিয়ে যাত্রীদের নানা ভোগান্তি লক্ষ্য করা গেছে। উত্তরবঙ্গের চিলাহাটিগামী নীল সাগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি সকাল ৮টায় স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও এটি স্টেশনে আসে ১০টায়। বেলা ১১টা পেরিয়ে যাওয়ার পর ট্রেনটি রওনা করে। কমলাপুর থেকে সকালে ধূমকেতু এক্সপ্রেস রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়েছে সোয়া ঘণ্টা দেরিতে। খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেসের বিলম্ব আড়াই ঘণ্টারও বেশি। রংপুরগামী রংপুর এক্সপ্রেস বেলা ৯টায় স্টেশনে আসার কথা থাকলেও সেটি বেলা ১১টায়ও কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছাতে পারেনি। এই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন শত শত যাত্রী। ভুক্তভোগী যাত্রীরা বলেন, এবার ট্রেনের শিডিউলে যেভাবে বিপর্যয় ঘটছে, অন্যান্য বছর এমন বিপর্যয় ঘটেনি। অনেক মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। দিনাজপুরগামী একতা এক্সপ্রেস ৫ নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেনটি সকাল ১০টায় কমলাপুর ছাড়ার কথা থাকলেও সেটি বেলা পৌনে ১১টায় কমলাপুরে আসে। এটি কখন ছাড়বে সে বিষয়েও তখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি স্টেশন কর্তৃপক্ষ। স্টেশনের কর্মকর্তারা জানালেন, ট্রেন দেরিতে পৌঁছানোয় কমলাপুর থেকে ছাড়তেও দেরি হচ্ছে। ভিড়ের কারণে যাত্রীদের ট্রেনে উঠতে এবং নামতেও সময় লাগছে বেশি। ফলে ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। এদিকে ঈদযাত্রায় সড়ক-মহাসড়কে বড় রকম কোনো বিপর্যয়ের খবর পাওয়া যায়নি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটেও আটকে থাকেননি যাত্রীরা। সর্বত্রই জেলা প্রশাসন, বিশেষ করে জেলা পুলিশের ব্যাপক তৎপরতায় সুশৃঙ্খলভাবে গাড়ি চলাচলে বাধ্য করা হয়েছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার এলাকায় দায়িত্বরত ঢাকা জেলা ডিবির ইন্সপেক্টর এ এফ এম সাঈদ জানান, থানা পুলিশ, ট্রাফিক বিভাগ, রিজার্ভ পুলিশসহ গোয়েন্দা সদস্যরাও বাড়িমুখী মানুষজনের যাত্রা নির্বিঘ্ন করার সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করে চলেছে। এ ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খলভাবে গাড়ি চলাচল নিশ্চিত করা যেমন দায়িত্ব, তেমনি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও কর্তব্য। রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় জানা যায়, দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের জিরো পয়েন্ট থেকে মহাসড়কের প্রায় সাত কিলোমিটার দীর্ঘ যানবাহনের লম্বা সারি পড়েছে। এদিকে নাব্যতা সংকটে গতকালও ব্যাহত হয়েছে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল। ঘাট ব্যবস্থাপক জানান, রাজধানীমুখী গরুর গাড়ির অতিরিক্ত চাপ ও নদীতে প্রচণ্ড স্রোত থাকার কারণে দৌলতদিয়া ঘাটে যানবাহনের দীর্ঘ সারি রয়েছে। ফেরি পার হতে না পেরে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যানবাহনের চালক ও গরু ব্যবসায়ীদের। এতে লোকসানের আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। নাব্যতা সংকটের কারণে আজও মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী ঘাটে আটকা পড়েছে তিন শতাধিক যানবাহন। ঘাট কর্তৃপক্ষ জানায়, কাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া নৌরুটের লৌহজং টার্নিং পয়েন্টে নাব্য সংকট দূর করতে নদীতে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু অপসারণের কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ। এতে ব্যাহত হচ্ছে ফেরি চলাচল।

কাঁঠালবাড়ী ফেরিঘাটে চলছে সিরিয়াল বাণিজ্য : মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, নাব্য সংকট আর ডুবোচরের কারণে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে কাঁঠালবাড়ী ঘাট এলাকায়। এতে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ যানজট। যাত্রীবাহী পরিবহন ও হালকা যানবাহন অগ্রাধিকার দিয়ে পার করায় বিপাকে পড়েছে ট্রাকচালকরা। এ সুযোগে সিরিয়াল বাণিজ্য করছে একশ্রেণির অসাধু চক্র। অভিযোগ উঠেছে পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। এতে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন পারাপারের অপেক্ষায় থাকা পরিবহন চালক, শ্রমিক ও সাধারণ যাত্রীরা। সরেজমিন দেখা যায়, কাঁঠালবাড়ী ফেরিঘাটের বিআইডব্লিউটিএর কাউন্টারের সামনে ১০ থেকে ১৫ জনের একটি টিম যাত্রীবাহী পরিবহন, ট্রাক, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসসহ অন্য ছোট-বড় যানবাহন থেকে টাকা নিচ্ছে। দেখে বোঝার উপায় নেই এদের মধ্যে কে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে টাকা নিচ্ছে আনসার বাহিনীর পোশাক পরিহিত কয়েকজন সদস্য। এদের মধ্যে আবার ভিন্ন পোশাকেরও কয়েকজন ট্রাক এলেই দৌড়ে গিয়ে টাকা নিয়ে আসছে। এভাবে এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে শতাধিক ছোট-বড় পরিবহন থেকে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছে চক্রটি। এরই মধ্যে সাংবাদিক দেখে কয়েকজন যুবক তেড়ে আসে, বাধা দেয় ছবি তুলতে। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, কাঁঠালবাড়ী ঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছেন তিন শতাধিক ট্রাকচালক ও শ্রমিক। টাকা উত্তোলনে জড়িত বিআইডব্লিউটিএর কর্মচারী পরিচয় দেওয়া সবুর হোসেন বলেন, ‘আমরা বিআইডব্লিউটিএ, আনসার বাহিনী, ঘাট ইজারাদারের লোকজন মিলে একসঙ্গে টাকা নিই। নির্ধারিত কুপনের বাইরে টাকা নেওয়া হয় না। তবে অন্যরা কিছু নিতে পারে। সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা সরকারি লোক। আমাদের মাঝে মাঝে স্থানীয় লোকজন সহযোগিতা করে। বাড়তি কোনো টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই।’ তবে ঝালকাঠি থেকে আসা পশুবাহী ট্রাকের চালক আবদুল মোবারেক বলেন, ‘আমি ভাঙ্গা থেকে এই পর্যন্ত পাঁচ জায়গায় টাকা দিয়ে এসেছি। সিরিয়াল করতে যেখানে আগে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা দিতে হতো, এখন সেখানে পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। টাকা না দিলে সিরিয়াল মিলছে না। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে এই চক্রের লোকজন রাখা আছে। পুলিশকে বললেও কাজ হচ্ছে না। তাদেরও বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। ফেরি কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি বললেও কাজ হচ্ছে না। তাদের যোগসাজশে স্থানীয় প্রভাবশালীরা টাকা তুলছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর