মঙ্গলবার, ২১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

কী হয়েছিল সেদিন

সাখাওয়াত কাওসার

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। বিকাল ৪টা থেকেই সন্ত্রাসবিরোধী সভা ও শোভাযাত্রা উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষে কানায় কানায় ভরে ওঠে। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু এভিনিউসহ আশপাশের এলাকা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিবা পরিবহনের খোলা ট্রাকে বানানো উন্মুক্ত মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। বিকাল ৫টার দিকে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে সমাবেশস্থলে পৌঁছান তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় ২০ মিনিট বক্তৃতা দেন তিনি। বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে বক্তৃতা শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল শুরুর ঘোষণা দেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে শুরু হয় একের পর এক পৈশাচিক গ্রেনেড হামলা। মুহূর্তে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় গোটা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। সন্ত্রাসবিরোধী সভা কভার করতে যাওয়া ফটোসাংবাদিকদের ছবি তোলার অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে প্রায় এক মিনিট অপেক্ষা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ওই এক মিনিট অপেক্ষা না করলে হয়তো রচিত হতো অন্য ইতিহাস। ভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুকন্যা বেঁচে গেলেও নিহত হন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন। আহত হন পাঁচ শতাধিক মানুষ। বিস্ফোরিত গ্রেনেডের ধোঁয়া ও পুলিশের ছোড়া কাঁদুনে গ্যাসে আচ্ছন্ন হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউসহ আশপাশ। শেখ হাসিনার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। নিক্ষিপ্ত গ্রেনেডগুলোর মধ্যে তিনটি অবিস্ফোরিত থেকে যায়। শত শত মানুষের আর্তচিৎকার, ছড়িয়ে থাকা ছিন্নভিন্ন দেহ, রক্ত আর পোড়া গন্ধ—সব মিলিয়ে বীভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয় পুরো এলাকায়। আহতদের সাহায্য করার বদলে বিক্ষুব্ধ ও আহত মানুষের ওপর বেপরোয়া লাঠিপেটা আর কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ে তৎকালীন সরকারের পুলিশ। মুহূর্তের মধ্যে দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করে সবাই।

নৃশংস সেই হামলার ১৪তম বার্ষিকী আজ। দলীয় সভানেত্রীকে বাঁচানোর জন্য ট্রাকের ওপর মানববর্ম রচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সেদিনের গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মারা যান ২৪ আগস্ট। তবে ওই দিনই নিহত হন মোস্তাক আহমেদ সেন্টু, ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, রফিকুল ইসলাম আদা, সুফিয়া বেগম, হাসিনা মমতাজ রীনা, লিটন মুন্সী ওরফে লিটু, রতন সিকদার, মো. হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মামুন মৃধা, বেলাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, আতিক সরকার, নাসিরউদ্দিন সর্দার, রেজিয়া বেগম, আবুল কাসেম, জাহেদ আলী, মমিন আলী, শামসুদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ, ইছহাক মিয়া এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও দুজন। হামলায় আহতের মধ্যে ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমান, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিল, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, প্রয়াত মো. হানিফ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, কাজী জাফর উল্লাহ, ওবায়দুল কাদের, ড. হাছান মাহমুদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আবদুর রহমান, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অ্যাডভোকেট রহমত আলী, সাঈদ খোকনসহ পাঁচ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ। দীর্ঘদিন চিকিৎসায় অনেকে কিছুটা সুস্থ হলেও পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে অনেককে। সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাণনাশের উদ্দেশ্যেই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। ফটোসাংবাদিকদের অনুরোধে সায় না দিলে প্রয়াত আইভি রহমানের জায়গায় লাশ হতেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। অথচ বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেদিন সংসদে কোনো শোক প্রস্তাবও তুলতে পারেনি আওয়ামী লীগ। শোক প্রস্তাব তুলতেই দেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনার প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে পরিচালিত সেদিনের সেই গ্রেনেড হামলায় যে চারদলীয় জোটের ইন্ধন ছিল, তা আজ অনেকটাই প্রমাণিত সত্য। আর সে কারণেই সেদিন জোট সরকার গ্রেনেড হামলার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। সিআইডিকে দিয়ে সাজানো হয়েছিল জজ মিয়া নাটক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর