মঙ্গলবার, ২১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন যারা

রফিকুল ইসলাম রনি

‘শরীরে পনেরোশ স্প্লিন্টার। রাতে এক ঘণ্টা ঘুম হয়। বাকি সময়টা এপাশ-ওপাশ করেই কাটাই। এখনো শব্দ শুনতে পাই সেই ভয়াবহ নারকীয় গ্রেনেডের শব্দ। মাঝে মধ্যে মনে হয়, এত কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে আত্মহত্যা করাই ভালো। কিন্তু না, আমাকে চিকিৎসাসহ আবাসনের ব্যবস্থা করে দিতে আমার নেত্রীও কম কষ্ট করেননি। আমি যদি আত্মহত্যা করি, তাহলে আমার নেত্রী কষ্ট পাবে।’ কথাগুলো সাভারের সেই ‘মৃত’ মাহবুবা আকতারের। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় পরদিন পত্রিকায় মৃতদের সঙ্গে যার ছবি ছাপা হয়েছিল। যিনি ছিলেন মৃতদের তালিকায়। ঘটনার পর ৭২ ঘণ্টা অজ্ঞান ছিলেন। মৃত মনে করে তাকে মেডিকেলের মর্গেও নেওয়া হয়েছিল। গতকাল তার সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ প্রতিদিনের এ প্রতিবেদকের। জানতে চাইলাম আপা কেমন আছেন? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—বেঁচে আছি, এটাই বড় কথা।

মাহবুবা বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী শান্তির সমাবেশে জননেত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা শেষে জয় বাংলা বলার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেনেডের বিকট আওয়াজ। ঢলে পড়লাম মাটিতে। তার পর আর কিছু মনে নেই...। ২৫ দিন পর কলকাতা টিএনএস হাসপাতালে প্রথম স্মৃতিশক্তি ফিরে পান তিনি। ৩০ দিন পর কলকাতা থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। সে সময়ে তার চিকিৎসার খরচ সম্পূর্ণভাবে নেত্রী শেখ হাসিনা বহন করছিলেন এবং তাকে থাকার জন্য ফ্ল্যাট দিয়েছেন জানান মাহবুবা। তিনি বললেন, জীবিত থাকা অবস্থায় নারকীয় এই গ্রেনেড হামলার বিচার দেখে যেতে চাই।

মাহবুবা আকতারের মতো রক্তাক্ত একুশে আগস্টের নারকীয় ঘটনা এখনো দুঃস্বপ্নের মতো তাড়িয়ে বেড়ায় অনেককে। ঘটনার ১৪ বছর পরও স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না সে দুঃসহ সময়ের কথা। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় গ্রেনেডের বীভৎস আওয়াজ, নিহতদের লাশ, আহতদের আর্তচিৎকার আর সহকর্মীদের বিলাপের স্মৃতির তাড়নায়। ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় মূল টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা। কিন্তু সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী এবং আওয়ামী লীগের সে সময়ের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ দলের তৎকালীন ২৪ নেতা-কর্মী সেদিন নিহত হন। আহত হন পাঁচ শতাধিক, যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন কিংবা কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি। মৃত্যুর এত কাছাকাছি গিয়ে আবার ফিরে আসায় হয়তো তারা নতুন জীবন পেয়েছেন কিন্তু যতদিন তারা বেঁচে থাকবেন ততদিন তাদের বহন করে যেতে হবে সেই দুঃস্বপ্নের মতো তাড়িয়ে বেড়ানো স্মৃতি, হঠাৎ করে গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার সে ঘটনাকে।

নারী নেত্রী আইভি রহমানের লাগোয়া ছিলেন তৎকালীন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং বর্তমান মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নাসিমা ফেরদৌস এমপি। তার শরীরেও ১ হাজার ৫০০ স্প্লিন্টার। ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন তিনি। অসহ্য যন্ত্রণায় এখনো ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না তিনি। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নেত্রী বক্তৃতা শেষ করে মাইকটি কারও হাতে দিচ্ছিলেন—এমন সময় যুগান্তরের ফটোসাংবাদিক এস এম গোর্কি আপাকে বললেন, আপা একটু দাঁড়ান—ভালো ছবি পাইনি। এরপরই একটা গ্রেনেড ফুটল। চারদিকে কালো ধোঁয়ায় অন্ধকার। আমি আইভি আপার সঙ্গেই ছিলাম। একটুপর উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। আইভি আপা মা বলে চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে লেগেন। ট্রাকের দিকে তাকিয়ে দেখি নেত্রীকে মানবঢাল করে রেখেছে। এরপর একেরপর এক গ্রেনেড হামলা হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেলে আনা হলে ফেলে রাখা হয় করিডরে। সেখানে চিকিৎসা হয়নি। রাতভর ঘুরলাম এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতাল। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি মনে পড়লে আজও ঘুমাতে পারি না। ‘ভয়ে কেঁপে ওঠে বুক, ঘুম ভেঙে যায়। বড় কোনো আওয়াজ শুনলেই আঁতকে উঠি। মনে হয়, আবার বুঝি ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পুনরাবৃত্তি ঘটল।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে অপশক্তি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এই ঘটনার বিচার দেখে যেতে চাই। যেন আর কেউ এমন ষড়যন্ত্র করতে সাহস না দেখায়।

আইভি রহমানের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন শাহিদা তারেক দীপ্তি (সাবেক সংসদ সদস্য)। নির্মম ওই ট্র্যাজেডি আইভি রহমানের জীবন কেড়ে নিলেও দেহে অসংখ্য স্প্লিন্টারের দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে এখনো তিনি বেঁচে রয়েছেন। শমরিতা হাসপাতাল ছাড়াও মিরপুরের সেলিনা হাসপাতাল এবং কলকাতায় পিটারসেন এবং ব্যাংককে তার দেহে অস্ত্রোপচার করে দুই শতাধিক স্প্লিন্টার বের করা হলেও এখনো তার দুই পাসহ সারা শরীরে বিঁধে রয়েছে পাঁচ শতাধিক ঘাতক স্প্লিন্টার।

ভয়াবহ ওই গ্রেনেড হামলায় আহত নেতাদের মধ্যে একজন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আকতার হোসেন। এখনো শরীরের অসংখ্য জায়গায় স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রতিদিন ২১ আগস্ট ফিরে আসে তার কাছে। কারণ স্প্লিন্টারের কারণে এখনো শরীরে যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন এ নেতা। তিনি বললেন, সেদিন আমার অবস্থান ছিল ট্রাকের কাছে। ওপরে তখন নেত্রীর ভাষণ চলছিলও। আমি বাহাউদ্দিন নাছিম, ইসয়াক আলী খান পান্না, নজরুল ইসলাম বাবুসহ অনেকেই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ করেই বিস্ফোরণ। এর মধ্যে একটি গ্রেনেড এসে বিস্ফোরিত হয় ট্রাকের কাছে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল মোস্তাক আহমেদ সেন্টু। ঘটনাস্থলেই সেন্টু মারা যায়। ওই বিস্ফোরণেই আমি আহত হই। রক্তাক্ত অবস্থায় আমি পড়ে থাকি রাস্তার ওপর। ১৪ বছর পার হলেও এখনো সুস্থ হয়ে উঠতে পারিনি। সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। চোখের সামনে অনেক নেতা-নেত্রীর নির্মম মৃত্যু ভেসে ভেড়াচ্ছে এখনো। মাথা, ঠোঁট, স্পর্শকাতর অংশে এখনো স্প্লিন্টার রয়ে গেছে। রাতের দিকে এত কষ্ট হয় যে মনে হয় বেঁচে থাকাটাই দুষ্কর।

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শরীরের কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মো. আবদুর রহমান সরদার। সেই ভয়াবহ হামলার দিন স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক আ. রহমানের দায়িত্ব ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার (তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী) গাড়ির নিরাপত্তা পাহারা দেওয়া। ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিজে আহত হয়েও বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন সভাপতি বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে। গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার কারণে এককালীন ৫ লাখ টাকা সাহায্য ও ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছেন। আ. রহমান সরদার বলেন, ১৪ বছর ধরে নিয়মিত ওষুধ খেয়ে যাচ্ছি। সপ্তাহে একবার চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। এত ব্যথা ছিল যে, যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে ব্যথার ওষুধ খেতে হয়। প্রতিদিন ২০০ টাকার ওষুধ খেতে হয়। গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার পর থেকে ভারী কোনো কাজ করতে পারি না। নেত্রী চিকিৎসার জন্য এককালীন ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। সেই টাকায় চিকিৎসা করিয়েছি। ১০ লাখ টাকার একটি সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন। ৩ মাস পর ২৬ হাজার টাকা পাই। ওই টাকা দিয়ে ঘরভাড়া, সংসার খরচ চলে। এভাবে বেঁচে আছি নেত্রীর সাহায্যের টাকায়। গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার পর সবাই ধরে নিয়েছিল শেখ বজলুর রহমান আর নেই। প্রতিবাদে মোহাম্মদপুরে গাড়িও ভাঙচুর হয়েছিল। কিন্তু পরে সবাই জানতে পারে উনি বেঁচে আছেন। অপারেশন করার সময় চিকিৎসকরা আবিষ্কার করলেন শরীরের বিভিন্ন অংশের মতো কিনডিতেও স্প্লিন্টার আছে। আর তা বের করতে না পারলে ওনাকে হয়তো বাঁচানো যাবে না। কিন্তু অপারেশন করতে গিয়ে চিকিৎসকরা থেমে যান। আবিষ্কার হলো তার শরীরে একটি কিনডি আছে আর তাতেই স্প্লিন্টারটা এমনভাবে আছে যা বের করতে গেলে তাকে বাঁচানোই যাবে না। যে স্প্লিন্টার গত ১৪ বছর ধরে বহন করে এখনো মৃত্যুকে জয় করে বেঁচে আছেন মহানগর আওয়ামী লীগের এ জ্যেষ্ঠ নেতা। সেই দিনের ভয়াবহ গ্রেনেড বিস্ফোরণের কথা স্মরণ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ বজলুর রহমান বললেন, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার মূল টার্গেট নিয়ে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে। আর এটি করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্র যারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা দেখতে চায় না।

সর্বশেষ খবর