বুধবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিএনপিতে ধরপাকড় আতঙ্ক

হাজারের বেশি নেতা-কর্মী আটক দাবি, ঢাকায় নেতাদের বাড়িতে পুলিশ

মাহমুদ আজহার

বিএনপিতে ফের গ্রেফতার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। দলের মধ্যম সারি থেকে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অনেকেই এখন ঘরছাড়া।  বিএনপি বলছে, ঈদের পর থেকে এ পর্যন্ত সহস্রাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখতে চায় সরকার। এ কারণে গ্রেফতার অভিযানের পাশাপাশি পুরনো মামলাগুলো সচল করা হচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, যাদের আটক করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা রয়েছে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, সারা দেশে ১৮ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় ৭৮ হাজার মামলা ঝুলছে। নতুন মামলাও হচ্ছে। আবার পুরনো মামলাগুলো সচল করেও কাউকে কাউকে গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। এর মধ্যে দলের কারাবন্দী চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেই ৩৫টি মামলা রয়েছে। লন্ডন অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর বড় অংশই মানহানির মামলা। দুর্নীতির এক মামলায় তাঁকে সাত বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ও দোরগোড়ায়। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৮৬টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে ১৪, ড. খন্দকার  মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ২০, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও তরিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১০টি করে, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬, মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে অন্তত অর্ধশত করে মামলা রয়েছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘১ সেপ্টেম্বর ঘিরে নেতা-কর্মীদের ওপর নতুন করে মামলা ও গ্রেফতারের খড়গ নেমে আসে। এখন শুনছি পুরনো মামলাগুলোও সচল করা হচ্ছে। আবার নিত্য নতুন মামলা করা হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনকে ব্যাহত করতেই সরকার আতঙ্কিত হয়ে এ কাজ করছে।’ পুলিশের সদর দফতরের উপ-মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) রুহুল আমিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে মামলা থাকলে পুলিশ তার কর্তব্য কাজ করতে বাধ্য। এর বাইরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কারও বাড়িতে হানা দিচ্ছে বা কাউকে গ্রেফতার করছে এমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই।’

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, বিএনপি যখন খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে তখনই সরকার গ্রেফতার বাণিজ্য শুরু করেছে। সরকার চায় না বিএনপি নির্বাচনে আসুক। কারণ, বিএনপি নির্বাচনে এলে সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপিই জামানত হারাবে। তবে মামলা-হামলা বা গ্রেফতার যাই হোক বিএনপি পিছপা হবে না। আন্দোলনের মাধ্যমে বেগম জিয়াকে মুক্ত করে নির্বাচনে যাবে বিএনপি। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, গত কয়েক দিনে বিএনপির মধ্যম সারির কয়েকজন নেতার বাসায় পুলিশ অভিযান চালায়। এর মধ্যে দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেলের বাসায় দুই দফায় অভিযান চালায় পুলিশ। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। অবশ্য ১ সেপ্টেম্বর নয়াপল্টনে জনসভায় হঠাৎ দেখা মেলে তার। জনসভায় বক্তব্য দিয়ে আবারও আড়ালে চলে যান বিএনপির এই নেতা। এ ছাড়া বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, সহ-স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার, যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, স্বেচ্ছাসেবক দল সভাপতি শফিউল বারী বাবু, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, ছাত্রদল সভাপতি রাজিব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানসহ অনেক নেতার বাসায় অভিযান চালানো হয়। এ কারণে মধ্যম সারি থেকে শুরু করে ঢাকা মহানগরের তৃণমূলের নেতারাও এখন আত্মগোপনে চলে গেছেন।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘দেশব্যাপী আবারও নতুন করে বিশেষ ক্ষমতা আইনে অথবা নিজেরাই নাশকতার মতো ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। ঈদের পর থেকে এ পর্যন্ত সহস্রাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নতুন মামলা হয়েছে কয়েক হাজার। সরকার মূলত আতঙ্কে ভুগছে। বিএনপি জানায়, বিএনপির কেন্দ্রীয় বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমেদ, তার ছেলে তানভীর আহমেদ রবিন, আনোয়ার হোসেন মজুমদার, আবু নাসের ফকির, জাফর আহমেদ, বাবুল তালুকদার, সুমন আহমেদ, রাকি সরদারসহ ৬০-৬৫ জনের নামে নতুন করে নাশকতার মামলা করা হয়েছে। একইভাবে শ্যামপুর থানায় ৯৮ জন, ডেমরা থানায় ১০৫ জন, ওয়ারী থানায় ২২৫ জন, সূত্রাপুর থানায় ১৩ জন, যাত্রাবাড়ী থানায় ৯৯ জন এবং তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। বিএনপি বলছে, ককটেল বা অন্যান্য বিস্ফোরক বস্তু দেখিয়েও বিএনপি নেতাদের নামে নতুন করে মামলা দেওয়া হচ্ছে।

সারা দেশে সাম্প্রতিক সময় নতুন মামলার চিত্র তুলে ধরে বিএনপি জানায়, বগুড়ায় জেলা যুবদলের সভাপতি সিপার আল বখতিয়ারসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক ও জীবন বিপন্ন চেষ্টার অভিযোগে মামলা দায়ের করে। এ ছাড়া যুবদল নেতা সোহাগ, সজীব, শৈবাল, প্রবাল, রাহী, টফিন, মামুনসহ অজ্ঞাত ২৫ জনের বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করে। শাহজাহানপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল বাশারসহ ৩৩ জনের নামে মামলা দায়ের করে পুলিশ। বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট সদর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মো. দেলোয়ার, শ্রমিক দল নেতা মনিরুল সরদার, জামাল শেখ, যুবদল নেতা মো. মোদাচ্ছের মেম্বারকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এ ছাড়া দলীয় পোস্টার লাগানোর অপরাধে শতাধিক নেতা-কর্মী ঘরছাড়া। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাসুদসহ চারজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পৌর বিএনপির হাজী আমিনুল ইসলাম আমিনসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হয়। এ ছাড়া হালুয়াঘাট উপজেলায় ৪৫ জন এবং ধোবাউড়ায় ৪৩ জন, তারাকান্দা ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর, শেরপুর, জামালপুরের মাদারগঞ্জ ও ইসলামপুরে ৫০ জনের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া ময়মনসিংহ জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি লিটন আকন্দ, ছাত্রদল সভাপতি রোকনুজ্জামান রোকনসহ ১৫৫ জনের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক মামলা দায়ের করা হয়। নেত্রকোনা জেলায় ১৫৭ জন, নড়াইলে ৩৫ জন, নওগাঁয় ৪০০ জন, ঝিনাইদহে ১০১ জন, নারায়ণগঞ্জে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকার, বিএনপি নেতা কাজী মনির ও মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দীপুসহ ৫৭ জন এবং সুনামগঞ্জের তাহেরপুরে ৪ শতাশিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে নওগাঁর আত্রাই উপজেলা বিএনপির চার শতাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। সোমবার দুপুরে আত্রাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)  মো. মোবারক হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর