শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইয়াবার পর নতুন আতঙ্ক খাত

অবৈধভাবে দেশে আসছে, বিক্রি বাড়ছে, ব্যবহার হয় সিসা বারেও

সাখাওয়াত কাওসার

ক্রেজি ড্রাগস ইয়াবার পর এবার দেশে নতুন আতঙ্ক ‘খাত’। বাংলাদেশ দিয়ে কেবল ট্রানজিটই হচ্ছে না, বাংলাদেশে ব্যবহারও হচ্ছে ‘গ্রিন টি’রূপী এ মাদক। অভিযোগ উঠেছে, প্রায় দুই বছর ধরে রাজধানীর অভিজাত এলাকার বিভিন্ন সিসা বারে সিসার সঙ্গে এ মাদক ব্যবহৃত হচ্ছে। তা ছাড়া বিপথগামী অনেক তরুণ ইয়াবার বিকল্প হিসেবে এ মাদক সেবন করছে। একইসঙ্গে হারবালসহ বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিতেও খাত ব্যবহৃত হচ্ছে এমন তথ্যও আসছে গোয়েন্দাদের কাছে। সম্প্রতি বিমানবন্দরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে খাত উদ্ধারের পর খাত নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। ভেষজ এ উদ্ভিদটি অন্যান্য প্রাণঘাতী মাদকের মতোই ভয়ঙ্কর বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে শরীরের ভয়ানক ক্ষতি ছাড়াও সেবনকারী আত্মহত্যায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ কেবল ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। খাত যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে সেজন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দেশে এ মাদকের ব্যবহার হয় কিনা তারও খোঁজখবর নিচ্ছি।’ তবে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো তথ্য তারা পাননি বলে মন্তব্য করেন তিনি। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ ইউনিটের প্রতিবেদনে খাতের বিষয়ে বলা হয়েছে, খাত বা মিরা নামের এ উদ্ভিদটি ‘নিউ সাইকোট্রফিক সাবস্টেনসেস’ বা এনপিএস নামে পরিচিত। অনেকে একে আরবের চা বলেন। খাত আন্তর্জাতিকভাবে ‘সি’ ক্যাটাগরির মাদক হিসেবে চিহ্নিত। গত বছরের মধ্যে বিশ্বের ১১০টি দেশ এ খাতকে মাদক হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের দেশে আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। একসময় ব্রিটেনের ক্যাফেগুলোয় অহরহ খাত ব্যবহৃত হলেও ২০১৪ সালে খাতের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আমদানি নিষিদ্ধ করে দেশটি। খাত মূলত পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ায় উৎপন্ন হলেও রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও অস্ট্রেলিয়ায়। জানা গেছে, গত ৩১ আগস্ট রাতে সিদ্বেশ্বরী ১৪৭ নেপচুন হাইটস্্ (বাসা) থেকে ৪০০ কেজি খাতসহ গ্রেফতার হন মো. নাজিম। পরে তাকে আদালতের নির্দেশে তিন দিনের রিমান্ডে নেয় ডিএনসি। বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর এই মাদকের ব্যবসায় তার জড়িয়ে পড়ার কাহিনী। বর্তমানে কারাগারে থাকা নাজিমের ঠিকানায় আসা আরও ১২০ কেজি খাত গতকাল শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জব্দ করেছে ডিএনসি। সিআইডি গত মঙ্গলবার ১ হাজার ৬০০ কেজি ও গতকাল ডিএনসি বিমানবন্দর থেকে আরও ১২০ কেজি খাত জব্দ করে। গতকাল রাজধানীর উত্তরা থেকে রাশেদুল আমীন ও এর আগে বুধবার মতিঝিল থেকে খাত আমদানির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে উজ্জ্বল মুন্সী নামে আরও একজনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। উজ্জ্বল মুন্সীকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে সিআইডি। দেশের বিভিন্ন বার ও অভিজাত এলাকার অনেক বিপথগামী যুবক ইয়াবার বিকল্প হিসেবে খাত সেবন করছেন।

সিআইডি সূত্র বলছে, ১ হাজার ৬০০ কেজি খাত আমদানির সঙ্গে জড়িত সবাইকেই আইনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। তবে রিমান্ডে উজ্জ্বল মুন্সী বলেছেন, ঢাকার কয়েকজন ব্যবসায়ীকে তিনি মাঝে মাঝেই খাত সাপ্লাই দিতেন। তারা এগুলো বিভিন্ন সিসা বারে সরবরাহ করতেন। মামলার তদন্তের স্বার্থে শিগগিরই উজ্জ্বলকে আবার রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করবে সিআইডি। তবে এক বছর ধরে জিপিওর বৈদেশিক শাখার মাধ্যমে একাধিকবার গ্রিন টির মোড়কে খাতের চালান এসেছে। ওইসব ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) উপমহাপরিদর্শক মো. শাহ্্ আলম বলেন, ‘ক্ষতিকর এ মাদকদের আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষা করতে কাজ করে যাচ্ছি। ইয়াবার মতো যাতে কোনোভাবেই ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য সচেতন সব মহলের সহযোগিতা দরকার।’

ডিএনসির অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদার বলেন, তারা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। দেশেও এর ব্যবহার হচ্ছে বলে তারা কিছু তথ্য পেয়েছেন। তবে যাচাই-বাছাই ছাড়া এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাচ্ছে না। নাজিমকে আবারও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

যেভাবে ক্ষতি করে : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ ও প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘ইয়াবার চেয়েও ভয়ঙ্কর হলো খাত। এতে থাকা ক্যাথিন মানুষকে আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। শুরুর দিকে শরীরকে স্টিমুলেট করলেও একপর্যায়ে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো অকেজো হতে থাকে।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাত সেবনকারী নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। প্রচুর অর্থহীন কথা বলে, বিভ্রান্ত ও নির্লিপ্ত হয়ে যায়। নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করতে থাকে। ঘুমের সমস্যায় ভোগে। খাতের ব্যবহারের দরুন মুখে ক্যান্সার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। প্রথম দিকে খাত উত্তেজক হিসেবে কাজ করলেও একপর্যায়ে যৌনক্ষমতা শূন্যের কোঠায় এনে দেয়।

যেভাবে খাত ব্যবসায় জড়ান নাজিম : গ্রেফতারের পর ডিএনসির হেফাজতে তিন দিনের রিমান্ডে থাকা নাজিম বলেছেন, তার বাবার নাম মৃত হাজী আনোয়ার আলী। গ্রামের বাড়ি তেতৈতলা, গজারিয়া, মুন্সীগঞ্জ। সিদ্ধেশ্বরীতে নেপচুন হাইটসে তিনি সপরিবার বসবাস করেন। নাজিম ২৭ বছর আগে দুবাই যান। দুবাইয়ের আল আবিরে প্রতিরক্ষা বিভাগে কাজ নেন অষ্টম শ্রেণি পাস নাজিম। দুই বছর চাকরির পর অ্যাড ফার্ম, পরে প্রিন্টিং ব্যবসা খোলেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় ইথিওপিয়ার নাগরিক আল বাহারের। তার প্ররোচনায় খাত ব্যবসায় নামেন নাজিম। এজন্য ২০১৬ সালে দেশে চলে আসেন। বাহারের মাধ্যমে পরিচিত হওয়া ইথিওপিয়ার আরেক নাগরিক আবদির সঙ্গে নিয়মিত খাত আমদানি ও গ্রিন টি লেভেল দিয়ে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায় রপ্তানি করেন। প্রতি ৫০০ কেজি পাচার করলে ১ হাজার ৫০০ ডলার পেতেন নাজিম। প্রতি কেজি খাত ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। এ মাদকের ব্যবসা করে নাজিম অল্প সময়েই বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা-কুমিল্লা রুটে ‘তিশা’ পরিবহনের দুটি কোচ, বালু বহনকারী কার্গো জাহাজ, দুবাইয়ে একটি অ্যাড ফার্মের মালিক তিনি। তার পরিবারের সবাই বিলাসী জীবন যাপন করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর