শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে নড়িয়া

রোকনুজ্জামান পারভেজ, শরীয়তপুর

যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে নড়িয়া

পদ্মার ভাঙনে বিলীন হচ্ছে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা। (উপরে) ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের আর্তনাদ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

দৃশ্যপট ১ : ২০ বছর হলো স্বামীকে হারিয়েছেন রহিমা বেগম। ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনি নিয়ে ৪ শতাংশ জমির ওপর বসবাস ছিল তার। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে অব্যাহত ভাঙনে তার সেই জমিটুকু পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। এখন রহিমা তার স্বামীর ভিটেমাটি গ্রাস করা পদ্মার দিকে শুধু চেয়ে থাকেন। বুকের ভিতরে ডুকরে ডুকরে কাঁদেন, কিন্তু তার প্রকাশ ঘটাতে পারেন না। রহিমা নড়িয়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত আবদুর রশিদ মাঝির স্ত্রী। রহিমা বলেন, ‘পদ্মায় বাড়িঘর সব চলে গেছে। আমি কোথায় এখন যাব? কোথায় থাকব?’ দৃশ্যপট ২ : কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও মুলফত্গঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী ইমাম হোসেন দেওয়ান ছিলেন কোটিপতি। সম্প্রতি তার বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সব হারিয়ে কোটিপতি থেকে তিনি পথে বসেছেন। থাকার জায়গাটুকু নেই। তাই এখন পরিবার নিয়ে এক আত্মীয়র বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। বয়স হয়েছে, মারা গেলে সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারছেন না তিনি। এটাই তার এখন সবচেয়ে দুঃখ। এই বাস্তবতায় অনেকেরই প্রশ্ন— রহিমা বেগম ও ইমাম হোসেন দেওয়ানের মতো আর কত পরিবারের ভিটেমাটি হারানোর পর ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়াবে সরকার?

প্রতিদিনই নদীর গ্রাস : পদ্মার অব্যাহত ভাঙনে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা বিলীন হচ্ছে। নড়িয়ার বাঁশতলা ও কেদারপুর এক সপ্তাহ বিরতির পর নতুন করে ভাঙনের কবলে পড়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ১০০ বসতঘর সরিয়ে নিয়েছেন ভাঙনকবলিতরা। এরপরও নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ৫টি ভবন। ভাঙনকবলিতরা এখন খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছেন। গত এক সপ্তাহে সরকারি-বেসরকারি ভবন ছাড়াও মুলফত্গঞ্জ বাজারের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং বহু লোকের সাজানো গোছানো ঘরবাড়ি ভাঙনে বিলীন হয়েছে। গত সোমবার রাতে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনটির অধিকাংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তার মধ্যেই হাসপাতাল ক্যাম্পাসের একটি আবাসিক ভবনে জরুরি বিভাগ, আন্তবিভাগ ও বহির্বিভাগ চালু রাখা হয়েছে। রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এখনো হাসপাতালের ১১টি ভবন ঝুঁকিতে রয়েছে। ফাটল দেখা দিয়েছে আরও একটি ভবনে।

অবশ্য হাসপাতালের সামনে দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুভর্তি জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ফেলার কাজ অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু জিও ব্যাগ কোনো কাজেই আসছে না। বছর ধরে নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর, মোক্তারের চর ইউনিয়ন ও নড়িয়া পৌরসভা এলাকায় পদ্মার তীব্র ভাঙন চলছে। এ নিয়ে শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো মাথাব্যথা নেই। ফলে ভাঙনকবলিতরা বসতবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। বাজারের পাকা দোকানগুলো নিজেদের উদ্যোগে ভেঙে ইট ও রড সরিয়ে নিচ্ছেন। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, ভাঙনকবলিতদের এখনো মেলেনি পুনর্বাসনের কোনোরকম ব্যবস্থা। তাই আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। অনেকেই না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে বাস করছে পরিবারের সদস্যরা। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেন, ‘পাঁচ দিন যাবৎ ভাঙনকবলিত এলাকায় আছি। এখানকার মানুষের সঙ্গে থেকে কাজ করছি। নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির একটি ভবনের বেশি অংশ নদীগর্ভে চলে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা নিরাপদ ভবনে দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৫ হাজার ৮২টি পরিবার নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ও আমার মায়ের নামে বেগম আশরাফুন্নেছা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছে।’ পাউবোর শরীয়তপুর কার্যালয়ের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী তারেক হাসান বলেন, ‘এ বছর ভাঙনের তীব্রতা অনেক। জিও ব্যাগ ফেলার কারণে কিছুটা কম ভাঙছে।’ জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, ‘ভাঙনকবলিতদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। সব পরিবারকে খাদ্য সহায়তা হিসেবে চাল ও শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। আর পুনর্বাসন সহায়তা হিসেবে টিন ও নগদ টাকা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।’

সর্বশেষ খবর