শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
অন্য চোখে দেখা

কী নিয়ে লিখব?

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

কী নিয়ে লিখব?

ইউনিভার্সিটি ছুটি হয়ে গেছে। বেশ কয়েক দিন হাতে। তাতে পত্রিকার জন্য লেখা দিতে পারি, বই লিখতে পারি অথবা আরাম-আয়েশে সময়টা কেটে যাক এই ভাব নিয়ে গান গাইতে বসলাম। কিন্তু বাদ সাধল পোস্টম্যান। সে কয়েকটি চিঠি নিয়ে এলো। সবগুলোতেই চেক। লিখে চেক পাওয়া একটি ভাগ্যের ব্যাপার। যদিও সামান্য টাকা। তবু এতেও কয়েকটি ইলিশ মাছ ধরে, পুঁটি মাছ, ট্যাংরা মাছ, লাউশাক অনায়াসে ব্যাগে জায়গা করে নেয়। তাহলে ওই চিঠিগুলো আমাকে উদ্বুদ্ধ করছে কিছু লিখতে।

সময়ের দাবি নির্বাচন। সবাই টেলিভিশন খুলে বসে আছে, কিন্তু কোনো বক্তাই মন খুলে কথা বলছে না। সব বলছে যেভাবে বলতে বলা হচ্ছে সেই ভঙ্গিতে। অর্থাৎ সব ভালো চলছে। ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ [শহীদ কাদরী]। অর্থাৎ সব ভালো চলছে। কোনোখানে কোনো গোলমাল নেই এবং এমন বক্তৃতা শোনানো হচ্ছে যা শুনে সম্পূর্ণ শয্যাগত ব্যক্তিও উঠে দাঁড়াবেন। যদি সেগুলো একত্র করে বলি তাহলে আমি নিশ্চয় একটা ভালো জায়গায় পৌঁছাতে পারব। কিন্তু আমার অভ্যাস খারাপ। সমাজের যেখানে অবক্ষয় সেখানেই দৃষ্টি যাচ্ছে। দেশে যে চব্বিশ লাখ বেকার মানুষ সমস্ত উপরি রোজগারগুলো সংগ্রহ করে এক পক্ষের গুণগান গাইছেন তাতে টেলিভিশন আর শ্রোতাদের আকর্ষণ করছে না। সংবাদপত্রগুলো পড়েছে মুশকিলে। শুধু সমর্থন, শুধু জয়গান, পড়ার জন্য জনগণ উৎসাহী নন। সার্কুলেশন বিভাগ ক্রমেই দূরবর্তী বিপদ সংকেত দেখিয়ে চলেছে। বড় কাগজগুলো হতাশাগ্রস্ত।

তাহলে কী এমন লিখব, যাতে ধরি মাছ না ছুঁই পানি পর্যায়ে কিছু বলার সুযোগ নেব। যেখানে কেউ ধরতে পারবে না। যারা ফেসবুকে লিখছেন তারাও পার পাচ্ছেন না। যদি গানবাজনার কথা বলি তাহলে কেমন হয়? তাহলেও সমালোচনা হবে। ‘বাংলার জল, বাংলার বায়ু, এক হোক হে ভগবান’, রবীন্দ্রনাথের অমর বাণী তো সত্যি হয়নি। আমরা তো ভাগ হয়ে গেছি, আর কোনো দিন এক হব না। আমাদের বিভাজন বাড়বে, কমবে না। তাহলে এ গান কেন আমরা গাইব? ক্রমেই সবার প্রতি হয়ে উঠছি হিংস্র। মুখে মিলনের কথা, ছুরিটি শানাচ্ছি সন্তর্পণে। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির ছাত্র, তারা পুরো ব্যাপারটি আঁচ করতে পারছেন। আমাদের দেশে বেশ কয়েকজন পশ্চিমা রাষ্ট্রদূত ঘুরে গেছেন। তারা কী বলে গেছেন, তা টেলিভিশনে বলেনি, সংবাদপত্রেও ছাপা হয়নি। আমরা শুধু আঁচ করতে পারি। তারা একবাক্যে বলেছেন, গণতন্ত্র সীমিত হবে না, গ্রহণযোগ্য হবে না।

সবচে মজা লাগে সম্পাদকীয় পড়তে। এরা লিখতে বসার আগে প্রথমে ভেবে নেন তারা সীমার মাঝে আছেন কিনা। এটা ভাবলে আর লেখা যায় না। মনে পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের কথা। পত্রিকার নামটি ‘ধূমকেতু’। পত্রিকা বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে তার বিশেষ বন্ধুরা প্রতিটি প্রবন্ধ নিয়ে এমন সমালোচনায় মুখর হতেন যে, মনে হয় ‘ধূমকেতু’টি তাদের স্পর্শ করেছে। অর্থাৎ তাদের লেজে আগুন ধরেছে। এগুলো আবার নতুন করে পড়লাম এবং বুঝতে চেষ্টা করলাম নির্ভীক সাংবাদিকতা মানে কী? জেলে গিয়েও নিস্তার নেই। সেখানে দুবার সাপ ঢোকানো হয়েছিল। আমার বইতে তা পুরোপুরি লেখা আছে। রেজাউদ্দিন স্ট্যালিন খবর পাঠিয়েছেন যে তাকে ভুল ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল, যাতে তিনি আর লিখতে না পারেন। ব্রিটিশরা না পেরে তাকে গ্রামোফোন কোম্পানির চাকরি দিল, যাতে তিনি সারা দিন গানবাজনায় মশগুল থাকেন, যাতে খবরের কাগজে আর লিখতে না হয়।

আজকের সম্পাদকীয়গুলো বাঁধিয়ে রাখার মতো। কারণ এগুলো সবই প্রশংসার চরম স্তরের। তাহলে সংবাদপত্রে মানুষ কী পাবে? আমি তাহলে কী লিখব? কেন, কোরআনের কথা বললে, রসুল [সা.]-এর কথা বললে, কেউ মারতে আসবে না। তাহলে আমার লেখা তো আমি লিখেই ফেলেছি। ৫১৫ পৃষ্ঠা। যেমন ধরা যাক, পাশ্চাত্য কেন মুহাম্মদ [সা.]-এর দিকে তাকাবে। কী আছে তাঁর কাছে, যা আর কারও কাছে নেই। কেন তিনি প্রয়োজনীয় আজকের দিনে?

পাশ্চাত্য কেন মুহাম্মদ [সা.]-এর দিকে তাকাবে?

৯-১১-এর পর কিছু মুসলমান ভাবছে যারা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার উড়িয়ে দিল, তারাই আমাদের ‘হিরো’। তারা তাদের জীবন বিসর্জন দিল ইসলামের জন্য। তারা ইসলামের নামে এক নতুন যুদ্ধ শুরু করল পৃথিবীর সবচে ধনী, শক্তিশালী ও পরাক্রান্ত দেশ আমেরিকার বিরুদ্ধে। মাত্র তিন হাজার ব্যক্তি এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। তাতে কী, আমেরিকা তো লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে ভিয়েতনাম ও ল্যাটিন আমেরিকায়। তার বেলা? ওরা মানবতার শত্রু, ইসলামের পয়লা নম্বর শত্রু। অধিকাংশ মুসলমান, বিশেষ করে আরব দেশেরা এই ‘হিরো’দের তাদের মডেল হিসেবে মানেনি। যারা প্লেন উড়িয়ে দিয়েছিল তাদের ইসলামের সৈনিক মনে হয়নি। এই যুদ্ধ ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত অনভিপ্রেত পরিকল্পনাহীন কতিপয় বিপথগামী তথাকথিত মুজাহিদের, যারা রসুল [সা.]-কে পাঠ করেছে ভিন্ন দৃষ্টিতে। এ পর্যন্ত পুবে ও পশ্চিমে ৯-১১ সম্পর্কিত যতগুলো বই বেরিয়েছে তাতে এই ‘হিরো’দের পৃথিবীর পয়লা নম্বরের শত্রু ও সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইসলামকে জানার জন্য, কোরআনকে বোঝার জন্য চিন্তাশীল ও নবীন লেখকরা এবার বই হাতে নিয়েছেন। সবাইকে বোঝাচ্ছেন অতর্কিত আক্রমণ, নিজ দেহে বোমা মেরে আত্মহনন রসুল [সা.] অনুমোদন করেননি। এটি ইসলাম নয়। এটি অন্য কিছু ছিল, যা মুসলমানদের সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করার চক্রান্তের অন্যায় ফসল। এটিও পশ্চিমের একটি অর্জন বটে।

সমসাময়িক বিশ্বে প্রতিবেশী হিসেবে ইসলামের সঙ্গে শত্রুতা হবে ভয়াবহ, যার নজির আমরা পেয়েছি বিগত বছরগুলোতে। তেমনি পরধর্মের সঙ্গে বাস করার মানসিকতা অর্জিত না হলে ইসলাম সন্ত্রাসীর চেহারায় একটি অমানবিক ধর্ম চিহ্নিত হবে। ইসলামের সঙ্গে শত্রুতা, মুহাম্মদ [সা.]-এর প্রতি অপমান থেমে যায়নি বলে অপর পক্ষে মানুষের মনে বাসা বেঁধেছে ভয়াবহ আণবিক শত্রুতার ভীতি। এটি মোটেই অসম্ভব নয়। সংবাদপত্রের পাতায়, সিএনএন-এর সংবাদ ভাষ্যে আণবিক শক্তির প্রলয় আমরা চোখে দেখতেও পারি, যা দেখেছি ৯-১১-তে। এটিকে কেউ কল্পনাতেও আনতে পেরেছিল?

আবার এর পেছনের খবরটিও অনুধাবন করা দরকার। আমেরিকায় যে ধর্মটি প্রতিদিন নতুন মানুষকে আকর্ষণ করছে, তার নাম ইসলাম। বেশ কয়েকটি মসজিদে গিয়ে নওমুসলিমদের সঙ্গে মোসাহাবা করেছি। জিজ্ঞেস করেছি : যারা ‘ট্রেড সেন্টার’ ধ্বংস করেছে তাদের ধর্মে কেন তোমাদের প্রবেশ? জবাব পেয়েছি :

 

নবীর ধর্ম ভালোবাসার ধর্ম।

নবীর ধর্ম বিগলিত করুণা জাহ্নবি যমুনা।

নবীর ধর্ম সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়া।

নবীর ধর্ম কাউকে অকারণে আঘাত না দেওয়া।

নবীর ধর্ম আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ সমর্পণ।

নবীর বিধান সবকিছু হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।

নবীর বিধান যা কিছু দিয়েছে আল্লাহ, ভাগ করে খাব।

নবীর বিধান সমাজে উঁচু-নিচু থাকবে, কিন্তু সবচে ভালো হবে সে, যে ফকির হবে।

ফকির হওয়ার জন্য মুসলমান হয়েছি।

পর্যবেক্ষণ করেছি তারা অজু করছেন অনেকক্ষণ ধরে। তাদের মনের ময়লা বুঝি সাফ হয়ে গেল। তারা সিজদা দিচ্ছেন অনেকক্ষণ ধরে। ওরাই জয়ী হবে, যারা আল্লাহর অন্বেষণে হবেন সফল। মনে হয় পাশ্চাত্যে নওমুসলিমরা যেভাবে নবী [সা.]-কে উপলব্ধি করছেন তাতে শত্রুরাই একদিন হবেন মানবতার পরম বন্ধু। জাহিলিয়ার আগে আরব দেশও এমনটি ছিল। কেমন করে রসুলুল্লাহর সোনার কাঠির স্পর্শে তারা হয়ে উঠল মানব শ্রেষ্ঠ। তাদের যেমন আছে মানবগুণ, তেমনি আল্লাহ তাদের দিয়েছেন প্রাচুর্য দুই হাতে ভরিয়ে।

যদি যুদ্ধই করতে হয়, তাহলে মুহাম্মদ [সা.]-এর মতো যুদ্ধ করতে হবে। আক্রান্ত হলে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকার নাম ইসলাম নয়। জীবন বিসর্জন দেওয়াই জীবন লাভ করার প্রকৃষ্ট উপায়। উপমহাদেশের ইতিহাসে মুসলমানরা জয়ী হয়েছে, কারণ তাদের জানা ছিল বিসর্জনের এই মহিমা। পৃথিবী ভয় পায় মুসলমানদের বিসর্জনের এই মন্ত্র। এটি ঐশী মন্ত্র। এর কোনো বিকল্প নেই। মুসলমানদের গায়ে, সম্মানে হাত দিলে শত্রু নির্মূল হবে এটাই মুসলমানদের তৌহিদী আমানত। প্রতিটি যুদ্ধে নতুন কৌশল। প্রতিশ্রুতি রক্ষার গুরুত্ব। কেন গিয়েছিলেন মুহাম্মদ [সা.] যুদ্ধ করতে। [লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর