রবিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
তিন যুবকের খুনি কারা

আহাজারি পরিবারে

মাহবুব মমতাজী

রাজধানীর অদূরে পূর্বাচল উপশহরের পথের ধারে গুলিবিদ্ধ তিন যুবকের লাশ নিয়ে এখনো রহস্য ঘুরপাক খাচ্ছে। হিসাব যেন মিলছে না ঘটনার নেপথ্যের কারণ নিয়ে। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে, পুলিশ পরিচয়ে তাদের যাত্রীবাহী বাস থেকে নামিয়ে অন্য গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বজনদেরও অভিযোগ, পুলিশ তাদের নিয়ে যাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ ছিল। পুলিশ এসব অভিযোগ অস্বীকার করার পর এ নিয়ে নানা ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। সবার এখন প্রশ্ন, তরতাজা এই তিন যুবকের খুনি কারা? কোথায় তাদের খুন করা হলো? খুনের নেপথ্য কারণইবা কি? পুলিশ বলছে, এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে তারা মাঠে নেমেছে। পুলিশের নাম করে কেউ তাদের তুলে নিয়েছিল কিনা এবং নেপথ্য কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। এদিকে নিহত তিন যুবকের স্বজনদের আহাজারি থামছে না। তারা জানতে পারছে না, তাদের প্রিয় মানুষদের কেন নির্দয়ভাবে হত্যা করা হলো। স্বজনদের অভিযোগ, পুলিশ তাদের নিয়ে গেল। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই কেন হত্যা করা হলো। পুলিশ এখন বলছে, তাদের নামে আগে থেকে মামলা ছিল। তবে তাদের কোনো পক্ষের সঙ্গে কারও কোনো ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটেনি। ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটলেও তারা সেটি জানতেন। সে ধরনের কোনো ঘটনা তাদের জানা নেই। তবে একজনের পকেটে ইয়াবা পাওয়ার দাবি করলেও তিন যুবককে তুলে নেওয়ার দায় স্বীকার করছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে ঘটনা যাই হোক না কেন, ঘটনার নেপথ্য কারণ ও খুনিদের অবিলম্বে গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর হতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাদিস উদ্দিন বলেন, তিন যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি খুবই স্পর্শকাতর। তবে যেখানে লাশ উদ্ধার হয়েছে সেই এলাকার পুলিশের দায়িত্ব খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করা। আর যেই এলাকা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, সেই এলাকার ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের তদন্ত হওয়া উচিত। এতে বেরিয়ে আসবে তারা ওই ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা। ঘটালে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ধরনের খুনের ঘটনা উদ্ঘাটিত না হলে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। নির্বাচনের আগে সরকারের ইমেজ নষ্ট হবে। এদিকে এ ঘটনার ব্যাপারে রূপগঞ্জ থানায় এসআই শফিউদ্দিন অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। শুক্রবার সকালে পূর্বাচলের আলমপুর ১১ নম্বর ব্রিজ এলাকা থেকে তিন যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতরা হলেন— রাজধানীর নিকুঞ্জ এলাকার মোহাম্মদ শহীদুল্লার ছেলে সোহাগ ভূঁইয়া (৩২), মুগদার মাণ্ডা এলাকার আবদুল মান্নানের ছেলে শিমুল আজাদ (৩০) এবং একই এলাকার আবদুল ওয়াহাব মিয়ার ছেলে নূর হোসেন বাবু (৩০)। তিনজনই রাজধানীতে ছোটখাটো ব্যবসায় জড়িত। তাদের পরিবারে স্ত্রী, সন্তান ছিল। তারা পরস্পরে পূর্ব পরিচিত। গতকাল রাত ৮টার দিকে সোহাগ ও বাবুর দাফন হয় বনানী কবরস্থানে। আর শিমুলের দাফন সম্পন্ন হয় গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে।

স্বজনদের অভিযোগ, ১২ সেপ্টেম্বর দিবাগত মধ্য রাতে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ায় পূর্বাশা পরিবহনের যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তিনজনকে নামিয়ে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তারা নিখোঁজ ছিলেন।

লাশ শনাক্তের পর সোহাগের ভাই শাওন বলেন, ‘আমার ভাই ডিসের ব্যবসা করত। গত বুধবার থেকে আমরা খুঁইজা পাইতেছি না। খুঁইজা না পাওয়ার পরে আমরা এলাকার সব জায়গায় খোঁজখবর নিছি, থানায় খোঁজ নিছি। তারা (পুলিশ) বলতে পারে না। ডিবি অফিসেও গেছি, খবর পাই না। পরে শুনছি, পুলিশে নিয়া গেছে। কিন্তু তার হদিস নাই। ডিবি নিয়া গেছে। পাই না, পাই না। তারপর আমরা নেটে, ফেসবুকে দেখলাম, ছবি। এরপরে আমরা যাই থানায়।’ তবে সোহাগ নিখোঁজের ঘটনায় কোনো থানাতেই সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়নি বলে জানান শাওন। তিনি এও বলেন, ‘সোহাগ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। আর কারও সঙ্গে শত্রুতাও ছিল না।’  সোহাগের স্ত্রী ফারজানা আক্তার বলেন, ‘যাওয়ার সময় ও (সোহাগ) আমাকে বলেছে, আমি কুষ্টিয়া যাইতেছি বেড়াইতে। আত্মীয়ের বাসায়। উনার নম্বর নিয়া দিছি ওইখানে দাঁড়াইয়া। ব্যাস, অতটুকুই জানি। আসার সময় আমারে খালি বলেছে, আমি বাসে উঠতেছি, তুমি গেটে তালা মাইরা রাখ। আমি সকালে আইসা তোমারে ফোন দিমু। এরপর থাইকা আমি কোনো খোঁজ পাই নাই। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিছি। কোনো খোঁজ পাই নাই আমি।’ নিহত শিমুল আজাদের স্ত্রী আয়েশা আক্তার আন্নি বলেন, ‘দুই দিন ধইরা  খুঁজতাছি, ফোন দিতাছি। খুঁইজা পাই না দেইখা, গাড়ি দিয়া কই জানি বেড়াইতে গেছে। আইতাছে। এরপর (মোবাইল) নম্বর বন্ধ। যেই গাড়ি দিয়া আইছে, ওই গাড়ির সুপারভাইজারে কইছে, দুইডা গাড়ি সামনে আইসা দাঁড়াইছে। এর পরে গাড়ি বন্ধ কইরা অগোরে নামাইয়া লইয়া গেছে। আপনেরা যে যাত্রী উডাইয়া দিছেন, হেই যাত্রী নামাইয়া নিয়া গেছে গা। হেই বেডায় আর বেশি কিছু কইতে পারে না। দুইডা সাদা গাড়ি আর লাল গাড়ি, মাইক্রো আইয়া থামাইয়া নিয়া গেছে। গাড়ি থামাইয়া অগো নাম কইয়া অগো ডাইকা নিয়া গেছে।’ নূর হোসেন বাবুর স্ত্রী মুক্তা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।

 লাশ শনাক্তের পর তিনিও জানালেন, বাবু স্টক ব্যবসা করত। দূরসম্পর্কের ভাইয়ের সঙ্গে তার ব্যবসা ছিল। ঢাকার বাইরে যাওয়ার সময় ছুটি লইছে, কইয়া যে ভাই, ঈদে যাই নাই কোথাও। ছুটি দেন। ঘুইরা আহি গা। ছুটিও দিছে। আমারে কইতাছে, তুমি তোমার মাগো বাসাতে ঘুইরা আহোগা। আমি যদি আইতে দেরি হয়, তাইলে তোমার মাগো বাসায় যাও। পরে ফোন দিছি দুপুরে, কই তুমি? কয়, আমি তো আমার এক পরিচিতর লগে দেহা হইছে। হের লগে ঘুরতে যাইতাছি। কই যাইতাছ ঘুরতে? কয়, আমি আইয়া পড়মু। আবার রাইতে ফোন দিছি, যে কই তুমি? কয়, আমি তো যশোর যাইতেছি। যশোর যাইতাছ, আইবা কহন? কয়, আমি সকালে আইয়া পড়মু। তারপরের দিন ফোন দিছি। কয়, আমি রাইতে গাড়িতে উঠমু ১০টায়। এরপর ওর নম্বর বন্ধ।’

তবে পুলিশের দাবি, গ্রেফতার সম্পর্কে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। নিহতরা মাদক ব্যবসায়ী ও থানায় মামলা রয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছে। এ ছাড়া নিহত একজনের প্যান্টের পকেটে ৬৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট পাওয়া গেছে। সোহাগ ভূঁইয়ার নামে বনানী থানায় চারটি মাদক ও একটি হত্যা মামলাসহ মোট পাঁচটি মামলা ছিল। শিমুল আজাদের নামে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়িতে মাদকের একটি মামলা ছিল। নূর হোসেনের নামে সম্ভাব্য দুটি মাদক, দুটি বিস্ফোরক ও একটি অন্য মামলা ছিল।

জানতে চাইলে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখনো আমরা ওই রহস্যের কোনো কিছু খুঁজে পাইনি। তবে পরিবারের সদস্যদের এ ঘটনায় হত্যা মামলার কথা বলা হলেও তারা রাজি হয়নি। যে কারণে পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর