বুধবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইন্দো-বাংলা পাইপলাইন উদ্বোধন

নতুন অধ্যায়ের সূচনা : শেখ হাসিনা । আঁধারে আলোর মশাল : মোদি

নিজস্ব প্রতিবেদক ও নয়াদিল্লি প্রতিনিধি

ইন্দো-বাংলা পাইপলাইন উদ্বোধন

ভিডিও কনফারেন্সে গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

ভারতের শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন’ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করলেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। এর ফলে জ্বালানি খাতে দুই দেশের সহযোগিতার নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো।

গতকাল বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার গণভবন থেকে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিল্লি থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।

এ সময় বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগিতা করায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিপক্ষীয় প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়ন সম্ভাবনা আরও সম্প্রসারিত হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ সব সময়ই ভালো প্রতিবেশী। ভারতের শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন নির্মাণ উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার আরেকটি মাইলফলক।

আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন দুই দেশের মধ্যে প্রগাঢ় সম্পর্কের প্রতীক, নতুন অধ্যায়। এটা দুই দেশের উন্নয়নে আঁধারে আলোর মশাল হবে। তিনি বলেন, আমরা শুধু প্রতিবেশী দেশই নয়, আমরা এক পরিবারের মতো, আমরা একে অন্যের দুঃখে হাত বাড়িয়ে দিই। আমরা প্রমাণ করেছি, চাইলে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সব সমস্যা সমাধান করা যায়। তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছরে আমাদের সহযোগিতা আরও উন্নত হয়েছে। জ্বালানি, বিদ্যুৎ, সড়ক, রেল যোগাযোগ খাতসহ আরও নতুন নতুন খাতে উন্নয়নে সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছি, আরও করব। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে মোদি বলেন, আপনার গতিশীল নেতৃত্ব ছাড়া দুই দেশের মধ্যে এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সম্ভব হতো না। অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে তার দীর্ঘায়ু কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জন্মদিনের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

অনুষ্ঠানে ভারতীয় ঋণের টাকায় বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা-টঙ্গী সেকশনের তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পেরও উদ্বোধন করা হয়। ‘বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন’ দিয়ে ভারতের শিলিগুড়ির নুমালীগড় তেল শোধনাগার থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর ডিপোতে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হবে। ২২ ইঞ্চি ব্যাসের এই পাইপলাইন দিয়ে বছরে ১০ লাখ মেট্রিক টন তেল সরবরাহ করা যাবে। ঢাকা-টঙ্গী সেকশনের তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত সরকার ঋণ হিসেবে দেবে ৯০২ কোটি ৬৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা। আর বাংলাদেশ সরকার ২০৪ কোটি ১৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকার জোগান দেবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, টঙ্গী-জয়দেবপুর হয়ে উত্তরাঞ্চল এবং চট্টগ্রাম ও সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ও দ্রুততর হবে বলে কর্মকর্তারা আশা করছেন। এ প্রকল্পের আওতায় এমব্যাংকমেন্টসহ ৯৬ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মিত হবে। এ ছাড়া ২৫টি কালভার্ট, ছয়টি প্লাটফর্ম, ছয়টি প্লাটফর্ম শেড, ১২টি ফুটওভার ব্রিজ, চারটি স্টেশন ভবন এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হবে।

ভিডিও কনফারেন্সের শুরুতেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, ভারতের পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাসবিষয়ক মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান বক্তৃতা করেন। এর পর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী সুইচ টিপে প্রকল্পগুলোর উদ্বোধন করেন। গণভবনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা উপস্থিত ছিলেন।

নতুন অধ্যায় সূচনা হলো : অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর থেকে আমরা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করি। বিগত সাড়ে নয় বছরে নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, বাণিজ্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পরিবেশ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি উন্নয়নের সহযোগিতা অনেক বেড়েছে। তিনি বলেন, ভারতের শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন নির্মাণ উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার আরেকটি মাইলফলক। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ সব সময়ই ভালো প্রতিবেশী। বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত সরকারের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত, আমাদের জনগণের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও অনেক আনন্দঘন মুহূর্ত উপস্থিত হবে।

ভিডিও কনফারেন্সে দিনাজপুরের পার্বতীপুরের জনগণের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আজ যে দুটি প্রকল্প উদ্বোধন করলাম, সরাসরি পাইপলাইনে তেল নিয়ে আসব। এর ফলে উত্তরাঞ্চলে যে তেলের সংকট ছিল তা কেটে যাবে। আর কখনো সংকট দেখা দেবে না। আমরা ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করব। প্রত্যেক গ্রামে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেব। তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আমাদের আরও এগিয়ে নেবে। আমরা স্থলসীমা ও ছিটমহল চুক্তি বাস্তবায়ন করেছি। দুই দেশের সহযোগিতায় যে উন্নয়ন করছি, তাতে বাংলাদেশের জনগণই উপকৃত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজকে উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭.৮৬ ভাগ। বাংলাদেশের এটা সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি। দেশের অর্থনীতি যথেষ্ট মজবুত। এ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে।

দুই দেশের উন্নয়নে আঁধারে আলোর মশাল : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের গতি আরও প্রগাঢ় হলো। ভৌগোলিকভাবে আমরা প্রতিবেশী দেশ, কিন্তু চিন্তাভাবনায় আমরা পরিবারের মতো। একে অপরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। একে অপরের উন্নয়নে হাত বাড়ানো— এটা আমাদের পারিবারিক সম্পর্কের মতো। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে আমাদের ভালো সম্পর্ক বিশ্বকে দেখিয়েছে প্রতিবেশী দেশ চাইলে কী না করা যায়। আমরা চার দশকের পুরনো সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করেছি। উন্নয়নের বিভিন্ন প্রজেক্টে আমাদের সব বিষয়ে অভূতপূর্ব প্রগতি রয়েছে। আপনার (বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) সঠিক নেতৃত্বের কারণেই আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর হচ্ছে। আজ থেকে ভারত-বাংলাদেশের মাল্টিপাইপ লাইনে কাজ শুরু হয়েছে। উন্নয়নে আমরা একসঙ্গে থাকব। এটা দুই দেশের উন্নয়নে আঁধারে আলোর মশাল হবে। এটা বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস এই পাইপলাইন বাংলাদেশকে মধ্যআয়ের দেশ হিসেবে তুলে ধরতে ভূমিকা রাখবে। ভারতেরও আর্থিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এই পাইপলাইন। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হচ্ছে, এটা বাংলাদেশের জনগণ উপভোগ করবে। এ ছাড়া রেললাইন নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে, যানজট কমে আসবে, মানুষের স্বস্তি ফিরবে। তিনি বলেন, আজ যে নতুন পাইপলাইন নির্মাণের উদ্বোধন হলো তা দুই দেশের সহযোগিতার মহাকাব্যে নতুন পালক।

সর্বশেষ খবর