বুধবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
বিশেষ সাক্ষাৎকারে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ

নির্বাচনে কে এলো না এলো বড় কথা নয়

নিজামুল হক বিপুল

নির্বাচনে কে এলো না এলো বড় কথা নয়

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়কমন্ত্রী। এর আগে ছিলেন পানিসম্পদমন্ত্রী। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এই রাজনীতিবিদ সচিবালয়ে নিজ দফতরে বসে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে। এ সময় তিনি কথা বলেছেন তার মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে ইত্যাদি নিয়ে। কথা বলেছেন আসন্ন সংসদ নির্বাচন এবং আরও অনেক বিষয়ে।

প্রশ্ন : আপনি তো প্রায় নয় মাস ধরে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। সরকারের প্রায় শেষ সময়ে দায়িত্ব নিয়েছেন। এই মন্ত্রণালয়ে কার্যক্রম সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ : আমার মন্ত্রণালয়ে আগে থেকে যথেষ্ট উন্নয়ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে বনায়নে ও পরিবেশ রক্ষার জন্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব সেক্টরে আমাদের ক্ষতি হতে পারে তার প্রতিকারে অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কিছু দিন আগে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ একটা ডেলটা প্ল্যান ২১০০ নিয়েছে। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের কী কী সমস্যা হতে পারে এবং সেগুলো অ্যাডাপটেশন (অভিযোজন) ও মিটিগেশনের (প্রশমন) জন্য কী কী প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। এটা একটা রিয়াল ডকুমেন্ট। এটা একটা লং টার্ম প্ল্যান। আমার জানা মতে এত লং টার্ম প্ল্যান আর নাই। আমরা সেই প্ল্যান গ্রহণ করেছি।

এবার বনায়নের কথা বলি। এক লাখ ৪৫ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের বাংলাদেশে প্রায় ২২ শতাংশ সবুজ আচ্ছাদনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশ বনায়নের জন্য আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা, আমরা আশা করছি সামাজিক ও গৃহস্থালি বনায়নের মাধ্যমে তা অর্জন করতে পারব। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বন রয়েছে সেখানে বন আরও বাড়ানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছি। বায়ু দূষণের বিষয়ে আমাদের যে কেইস প্রজেক্ট আছে সেখানে কাজ হচ্ছে। আমরা নতুন ইটভাটা আইনটি শিগগিরই মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করানোর চেষ্টা করছি। এই সংসদে যদি সেটা পাস করা না যায় তাহলে অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করব। তাহলে ইটভাটার মাধ্যমে যে বায়ুদূষণ হয় সেটা অনেকখানি কমাতে সক্ষম হব। নদী দূষণের বিষয়েও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ‘জিরো টলারেন্স’-এর মাধ্যমে আমরা নদীগুলোকে রক্ষার চেষ্টা করছি। এ জন্য পরিবেশ অধিদফতরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, প্রতিটি শিল্প কারখানা যেখানে পানির ব্যবহার আছে সেখানে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ক্যাপাসিটির ইটিপি স্থাপন যেন নিশ্চিত করা হয়।

প্রশ্ন : জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের উপকূল এলাকার জনজীবন চরম ঝুঁকিতে, বাস্তুচ্যুত হচ্ছে মানুষ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে কীভাবে পুনর্বাসন করা হবে এবং ক্ষতি মোকাবিলাইবা করা হবে কীভাবে?

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় প্রতিনিয়ত এ ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। যদিও সম্পূর্ণভাবে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে সচেতন। বিশেষ করে এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে যারা বাস্তুচ্যুত হয় তাদের পুনর্বাসন করার জন্য। আর ক্ষয়ক্ষতি যেটা হচ্ছে একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশেষ করে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে। অন্যদিকে হিমালয়ের বরফ গলে আমাদের নদীর পানি প্রবাহ এমন একটা সময়ে বাড়বে যে, আমাদের পানির কোনো প্রয়োজন হবে না। যেমন বর্ষাকাল এবং গ্রীষ্মকাল এই সময়ে পানির প্রবাহ বেড়ে যেতে পারে। এতে করে বন্যা হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের ঋতু প্রবাহ যেমন শীতের সময় শীত, বর্ষার সময় বর্ষা তার কোনো স্থিতিশীলতা নাই। দেখা যাচ্ছে যখন বর্ষা হওয়ার কথা তখন হচ্ছে না। এতে ঋতুর পরিবর্তনটা যদি হয় তাহলে আমাদের ...।

প্রশ্ন : বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ পয়েন্ট ৫ রাখার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে সব সময় দাবি জানানো হচ্ছে। সেই দাবি আসলে কতটা পূরণ হতে পারে?

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ : আমরা চেষ্টা করব যাতে পশ্চিমা দেশগুলো তার সঙ্গে চীন, রাশিয়া, ভারত তাদের যে অ্যামিনেশন লিমিট আছে সেই লিমিটের মধ্যে যেন তারা থাকে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসছে এবং তারা এমন কিছু কার্যক্রম শুরু করেছে যার ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা কমার বদলে বাড়ছে। তবে আমেরিকার জনগণ ট্রাম্প সরকারের সঙ্গে একমত নয়। অনেকগুলো অঙ্গরাজ্য বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব ক্ষতি হচ্ছে তা মোকাবিলার জন্য যা করার দরকার তারা সেটা করবে।

প্রশ্ন : জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের তহবিলের সর্বশেষ অবস্থা কী? অভিযোগ আছে এই তহবিল থেকে অনেকগুলো প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় কোনো ভূমিকা রাখছে না।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ : দেখুন আমাদের ছয়টা থিমেটিক এরিয়া আছে। এসব এরিয়ার মধ্যেই আমরা কাজ করব। আর কিছু ফান্ড রিসার্চের জন্য... একই সঙ্গে আমরা একটা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা নিয়েছি। যাতে আমরা প্রকৃতভাবে চিহ্নিত করতে পারি যে কোনোটা আমাদের জলবয়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিছু জায়গায় আমরা ফান্ডিং বন্ধ করে দিয়েছি। যেমন নদী ভাঙনে। নদী ভাঙনে বরাদ্দ দিলে সেখানে কাজের স্থায়িত্ব থাকে না। এরকম প্রকল্পে আমরা ফান্ডিং অনেক কমিয়ে দিয়েছি। এখন আমরা যেটা করছি সেটা হচ্ছে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা যেসব এলাকায় লবণাক্ততা আছে, সোলারের ব্যবস্থা করা, দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেসব জেলা সদরে জলাবদ্ধতা আছে সেগুলোর ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য আমরা ফান্ড দিচ্ছি। বিশেষ করে বনায়নের ওপরই আমরা জোর দিচ্ছি। বন আমাদেরকে সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস থেকে যেমন রক্ষা করে ঠিক একইভাবে আমাদের কার্বন ডাই-অক্সাইড অ্যামিনেশন কমিয়ে দেয়।

প্রশ্ন : এই যে আমাদের দেশের বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাচ্ছে, পাহাড় কেটে ঘর-বাড়ি বানানো হচ্ছে এটা তো পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ...।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ : আমরা বনায়ন রক্ষা করার জন্য বিশেষ করে আমাদের যে জনবল সেটাকে একটা সিস্টেমের মধ্যে আনার চেষ্টা করছি। জনবল বাড়ানো এবং প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট পাওয়ার চেষ্টা করছি। তবে বনায়ন রক্ষার ব্যাপারে বনের কর্মকর্তা যারা আছেন তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বনে যারা কাজ করছেন তাদের কমিটমেন্ট আছে বন রক্ষায়।

প্রশ্ন : জাতীয় নির্বাচন তো চলে আসছে। নির্বাচন নিয়ে আপনার ভাবনা কী? বিএনপি নির্বাচনে আসবে বলে মনে করেন?

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ : নির্বাচন যথা সময়ে এবং সংবিধান অনুযায়ীই হবে। এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। বিএনপি আসবে কি না সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। যে কোনো পলিটিক্যাল পার্টির রাইট আছে নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার। কোনো দল আরেক দলের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বলা উচিতও না, ঠিকও না। কারা এলো না এলো, এটা একান্তই তাদের দলের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে আমি যেটা মনে করি, দেশের একটা সংবিধান আছে, সংবিধানে বলা আছে নির্বাচন কীভাবে হবে এবং নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আপনারা জানেন, নির্বাচন শিডিউল ঘোষণার পর ওই সময়ে যে নির্বাচনকালীন সরকার থাকে তারা শুধু রুটিন ওয়ার্ক করে। তারা কোনো নীতিগত নতুন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা। আমি বিশ্বাস করি নির্বাচন হবে এবং বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে যদি নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার তেমনি এটা সাংবিধানিক দায়িত্বও।

প্রশ্ন : ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দেশে একটা সহিংস অবস্থা দেখা দিয়েছিল। নির্বাচন বর্জন করার ঘোষণা দিয়ে বিএনপি-জামায়াত তখন হিংস্র হয়ে গিয়েছিল। আগামী নির্বাচনে সে রকম কোনো পরিস্থিতির আশঙ্কা করেন?

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ : না, আমি সেরকম কোনো আশঙ্কা করি না। তবে আমি বিশ্বাস করি কেউ নির্বাচন অংশগ্রহণ না করলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তারা যতটুকু করার ততটুকু করবে। কোনো রকম নাশকতা বা ধ্বংসাত্মক কাজ করা কোনো রাজনৈতিক দলের একেবারেই অনুচিত হবে।

প্রশ্ন : গ্রহণযোগ্য নির্বাচন...

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ : দেখুন নির্বাচনে কে অংশ নিল কে নিল না, সেটা কোনো বড় কথা নয়। নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, নির্বাচনে যদি কারচুপি না হয়, সন্ত্রাসী কার্যক্রম না হয়, পেশি শক্তির খেলা না হয়, নির্বাচনে যদি টাকার খেলা না হয় এবং নির্বাচন কমিশন যদি একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে তাহলে আমি মনে করি, সে নির্বাচন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

প্রশ্ন : বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে আপনাদের দল জাতীয় পার্টি এককভাবে ৩০০ আসনে নির্বাচন করবে এমনটাই বলছেন আপনাদের দলের চেয়ারম্যান...

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ : আমি যতটুকু জানি ৩০০ আসনেই আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। সে জন্য সমস্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে যে কোনো নির্বাচনের সময় এলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কী করে আমরা নির্বাচন করব। সেটা জোটগত হবে নাকি নিজেরা করব। সেই সিদ্ধান্ত সাধারণত শেষ মুহূর্তেই নেওয়া হয়। আর এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সব ক্ষমতা আমাদের পার্টির চেয়ারম্যানের।

প্রশ্ন : বিকল্পধারা, নাগরিক ঐক্য, গণফোরাম একসঙ্গে জাতীয় ঐক্য করার জন্য একটা প্লাটফরম তৈরি করেছে। এটিকে কীভাবে দেখছেন?

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ : দেখুন জাতীয় ঐক্য করার জন্য যে কেউ চেষ্টা করতে পারে। যারা জাতীয় ঐক্য করার চেষ্টা করছেন সেটা করা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। সুতরাং এই ব্যাপারে আমার বলার কিছু নেই। তবে জাতীয় ঐক্য হতে হলে যাদের ওপর মানুষের আস্থা আছে তাদের সবার পার্টিসিপেশন থাকা দরকার।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।

সর্বশেষ খবর