রবিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

এক মঞ্চে কামাল বি চৌধুরী ফখরুল রব মান্না সুলতান

জাতীয় ঐক্যকে এগিয়ে নেওয়ার ঘোষণা

নিজস্ব প্রতিবেদক

এক মঞ্চে কামাল বি চৌধুরী ফখরুল রব মান্না সুলতান

রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে গতকাল জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নাগরিক সমাবেশে নেতারা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

আগামী ১ অক্টোবর থেকে একসঙ্গে সারা দেশে আন্দোলন-কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় ঐক্যের নেতারা। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের পদত্যাগসহ পাঁচ দফা আদায়ে দেশের জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন-ওয়ার্ডে সব শ্রেণি-পেশার নাগরিককে নিয়ে কমিটি গঠনেরও ঘোষণা দেওয়া হয়। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ গণজাগরণের কর্মসূচি অব্যাহত রাখারও ঘোষণা দেওয়া হয়। সমাবেশ থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়। একইসঙ্গে সরকারকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়, আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। গতকাল রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার উদ্যোগে নাগরিক সমাবেশ থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। প্রধান বক্তা ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বক্তব্য দেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. আবদুল মঈন খান, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, শিক্ষাবিদ মোমেনা খাতুন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী, বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর আবদুল মান্নান (অব.), গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু, সাইদুর রহমান, বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নিতাই রায়চৌধুরী, আবদুস সালাম আজাদ প্রমুখ। বক্তব্য শেষে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। এ সময় সবাই হাত তুলে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ঘোষণাপত্রকে সমর্থন জানান। সমাবেশে জামায়াত ছাড়া ২০-দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশজুড়েই ছিল বিএনপি নেতা-কর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি। নাট্যমঞ্চের আশপাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য উপস্থিত থাকলেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

সমাবেশে যোগ দেন ২০-দলীয় জোটের শরিক বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, আহসান হাবিব লিংকন, বিকল্পধারার যুগ্মমহাসচিব মাহী বি চৌধুরী, খেলাফত মজলিসের মাওলানা মজিবুর রহমান, আহমদ আবদুল কাদের, এনপিপির ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, নূর হোসাইন কাসেমী, জাগপার খোন্দকার লুত্ফর রহমান প্রমুখ। সভাপতির বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘কেউ কেউ আমাদের এ-জাতীয় ঐক্যের প্রচেষ্টায় ক্ষমতায় যাওয়ার ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। আমরা প্রকাশ্যে সভা করছি, কোনো গোপন বৈঠক করছি না। যারা জনগণের শক্তিকে ভয় পায়, তারা জনগণের সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টাকে ষড়যন্ত্র বলে জনগণকেই অপমান করছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা জনগণের ভোটাধিকারসহ মৌলিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কার্যকর গণতন্ত্র, আইনের শাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছি। জনগণ তাতে ব্যাপক সাড়া দিয়েছে। মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ।’

দশ ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করে এর জবাব চান যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘যে স্বাধীনতা আনতে লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন, মা-বোনকে ইজ্জত দিতে হয়েছে— তার মূল্যবোধ আজ কেন পদদলিত? দিনরাত আতঙ্কে কেন থাকবেন মা-বোনেরা, শঙ্কায় থাকবেন গুম, রাহাজানি নিয়ে, কেন পুলিশ, র‌্যাব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের ছাড় দেবে? এ অধিকার কে দিয়েছে আপনাদের? কেন কোটা সংস্কারের পক্ষে আমাদের মেধাবী ছাত্রদের আন্দোলন করতে হবে? কেন তাদের গুন্ডা দিয়ে, হাতুড়ি, চাপাতি দিয়ে আক্রমণ করা হবে, এর জন্যই কি স্বাধীনতা?’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গী আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র কোথায়? কেন গঙ্গার পানি পাব না, কেন বন্ধুরাষ্ট্র তিস্তার পানি দেবে না, কেন, কেন? এখন রুখে দাঁড়ানোর সময়।’ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সবাই এ সরকারের পরিবর্তন দেখতে চান। দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি দিতে হবে। যিনি সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন, তাকে আজ অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলায় কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়া বলে গিয়েছিলেন আগে দেশকে বাঁচাতে হলে, মানুষকে বাঁচাতে হলে জাতীয় ঐক্য ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সবাই এক হয়ে মানুষের বুকে পাথরচাপা দিয়ে বসে থাকা স্বৈরাচারকে সরাতে হবে। এজন্য জনগণের ঐক্যই হচ্ছ একমাত্র বিকল্প।’ বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলনে হাজার হাজার প্রাণ গেছে। বিএনপির ৫০০-এর বেশি নেতা-কর্মী গুম হয়েছেন। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মামলা নতুন করে দেওয়া হয়েছে। ইতোপূর্বে ৭৮ হাজার মামলা দেওয়া হয়েছিল। এই ১৮ দিনে মামলার সংখ্যা হচ্ছে ৩ হাজার ৭৭৬, এজাহার দেওয়া হয়েছে ৭৮ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। অজ্ঞাত নামে মামলা দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। ঘরে ঘরে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই— আন্দোলন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা। আগামী নির্বাচনে যাতে অংশ নিতে না পারে।’

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াই প্রথম জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। আজ এই প্ল্যাটফরম থেকে জাতীয় ঐক্যের শুরু হলো।’ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘এই স্বৈরাচারকে সরাতে হলে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে।’ জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য মানে জনগণের ঐক্য। যখন জনগণের ঐক্য হয়, তখন স্বৈরাচার পালিয়ে যায়। দেশ আজ গুম, খুন ও বেওয়ারিশ লাশের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। আজকে ব্যাংক লুট করে নেওয়া হয়েছে। কখন যে মানচিত্র লুট করে নিয়ে যায়, সেই চিন্তায় আছি। এ মুহূর্তে দরকার, নির্দলীয় সরকার।’ নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এ অবস্থায় কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে? আমরা কি আমাদের ভোট সুষ্ঠুভাবে দিতে পারব? আমরা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। কিন্তু আমাদের হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে বলা হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। আমরা খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি চাই।’ ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ বলেন, ‘এই জাতীয় ঐক্য হবে দলে দলে নয়, নেতায় নেতায় নয়, ঘরে ঘরে, জনে জনে।’ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘বিদ্যমান অবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন।’ গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকী বলেন, ‘দেশে একটি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জামায়াতসহ ’৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজনীতি করতে পারবে না।’

সর্বশেষ খবর