রবিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সিনহার বই সংবিধান লঙ্ঘন বললেন আইনজীবীরা

আরাফাত মুন্না

নিজের আত্মজীবনী এবং বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে বই লিখে নতুন করে আলোচনায় আসা সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা নিজের প্রণীত আচরণবিধিও ভঙ্গ করেছিলেন বলে অভিযোগ আইনজ্ঞদের। তারা বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বিচারপতি সিনহা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের জন্য ৩৯ দফা আচরণবিধি প্রণয়ন করে দিয়েছিলেন, তার অধিকাংশ তিনি নিজেই লঙ্ঘন করেছেন। তারা আরও বলেন, তিনি একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, একটি বিশেষ মহল বা দলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য মিথ্যাচারমূলক এমন বই প্রকাশ দুঃখজনক।

এ বিষয়ে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিচারপতি সিনহা সবসময় কোড অব কন্ডাক্ট লঙ্ঘন করেছেন। এমনকি ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে তিনি নিজে যেসব কোড অব কন্ডাক্ট প্রণয়ন করে দিয়েছিলেন, তিনি নিজেই ওগুলো কখনো মানেননি। বিচারপতি মানিক বলেন, তিনি যুদ্ধাপরাধীর পরিবারের অনুরোধে আমাকে বেঞ্চ থেকে বাদ দিয়েছিলেন। একজন প্রধান বিচারপতি হিসেবে কোনো আসামির অনুরোধ রাখার কোনো অধিকারই তার নেই। খাসকামরায় আসামির পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তিনি চরমভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। ওই ঘটনায় বিচারপতি সিনহার শপথও ভঙ্গ হয়েছে বলে অভিযোগ বিচারপতি মানিকের।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শ ম রেজাউল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিচারপতি এস কে সিনহা প্রায়ই রাজনৈতিক নেতার মতো বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে এককভাবে নিজেকে ফোকাসে আনার চেষ্টায় মত্ত ছিলেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তার এসব ঘটনা শুধু নয়, অনেকগুলো বিষয়ের ফলে ১/১১ সরকার আমলেও বঙ্গভবনে ‘চায়ের দাওয়াত’ পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, বিচারপতি সিনহার লেখনীতে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয়েছে, তিনি আক্রোশ বশত সরকার ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থাসহ জাতীয় সংসদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। কোনোভাবেই এসব বিষয় মামলার বিচার্য বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না। ফলে তিনি নিজেই বিচারিক দৃষ্টির বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের মধ্যে অবান্তর প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। এটা তার বিরুদ্ধেই বিচার্য ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তিনি আরও বলেন, বিচারপতি এস কে সিনহা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকেই জনমনে খেল করে ফেলেছিলেন। তার লেখার মধ্য দিয়ে সিনহা নতুন করে কোনো দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখছেন বলেও মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। এ বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিচারপতি সিনহা যখন প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন, তখনই তিনি শপথ নিয়েছিলেন ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে রাগ-অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করবেন না। কিন্তু তিনি বিচারপতি থাকা অবস্থায় বার বার তার শপথভঙ্গ করেছেন। তিনি সাকা চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে খাসকামরায় সাক্ষাৎ করেছেন। এটা শপথভঙ্গের শামিল। তিনি বলেন, বিচারপতি সিনহা শপথ নিয়েছিলেন, ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থাকবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি এখন বই লিখে বলছেন, তাকে জোর করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। তাকে যদি ভয়ভীতি দেখানো হয়েই থাকে তখন এজলাসে বসে কেন এসব কথা বললেন না, প্রশ্ন এই আইন কর্মকর্তার।

আইনজ্ঞরা বলেন, বিচারপতি এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে বিচার বিভাগে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, জেলা জজ আদালত পরিদর্শন, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, মাজারের ওরস উদ্বোধন, মন্দির উদ্বোধন এবং উন্মুক্ত আদালতে বসে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্য, সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রদান করেছেন। তার এসব কর্মকাণ্ড ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের জন্য দেওয়া কোড অব কন্ডাক্টের ১ ও ১৫ ধারা লঙ্ঘন। এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে তার দায়িত্বগ্রহণের বর্ষপূর্তিতে টেলিভিশন ও গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজের প্রণীত আচরণবিধির ২১ ও ২২ ধারা লঙ্ঘণ করেছেন। বিচারপতি সিনহা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় উপঢৌকন গ্রহণ করেছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। আশিয়ান সিটি, সিটিসেলসহ বিভিন্ন বড় কোম্পানির প্রতিনিধি বা মালিকরা তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে নানা উপহারও দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব কর্মকাণ্ড আচরণবিধির ২৫ ও ৩৪ ধারার সরাসরি লঙ্ঘন। এ ছাড়া কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর আপিল শুনানি চলাকালীন সময়ে তার পরিবারের সদস্যরা তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে আপিল বেঞ্চ থেকে বাদ দেওয়ার অনুরোধ জানান। তাদের অনুরোধে এস কে সিনহা বিচারপতি মানিককে বেঞ্চ থেকে বাদও দিয়েছিলেন। সিনহার এই কর্মকাণ্ড তার প্রণীত আচরণবিধির ১১, ১৭, ৩০  ও ৩১ ধারার লঙ্ঘন। আইনজ্ঞরা আরও বলেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ চিহ্নিত সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন বিচারপতি সিনহা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে ভারত, সিঙ্গাপুর, কানাডা, ইংল্যান্ড ও আমেরিকা সফরের সময় ওইসব দেশে অবস্থানরত সরকারবিরোধী নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তিনি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার লন্ডনে অবস্থানরত এক আত্মীয়ের বাসায়ও গিয়েছিলেন সিনহা। ওই বাসায় এক বৈঠক থেকেই তাকে রাষ্ট্রপতি করার প্রস্তাব দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। তার এসব অভিযোগ ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে দেওয়া আচরণবিধির ৫, ১২, ১৭, ২৭ ও ২৮ ধারার লঙ্ঘন। সুপ্রিম কোর্টের একাধিক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, দৈনিক জনকণ্ঠে সাকা পরিবারের সঙ্গে সিনহার সাক্ষাতের সংবাদ প্রচারের পর পত্রিকাটির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন বিচারপতি সিনহা। এই মামলার শুনানিতে  জনকণ্ঠের আইনজীবী সালাউদ্দিন দোলন বার বার বলেছিলেন, যেহেতু অভিযোগটি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে তাই কোড অব কন্ডাক্ট অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি এই মামলার শুনানি গ্রহণ করতে পারেন না। তবুও বিচারপতি সিনহা ওই মামলার শুনানি নিয়ে জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদককে দণ্ড দিয়েছিলেন। এটা আচরণবিধির ২৩ ধারার লঙ্ঘন। এ ছাড়া ব্যক্তিগত সম্পদ আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করেননি সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা। এটাও আচরণবিধির ১৬ ধারার লঙ্ঘন।

একটি মহলকে সুবিধা দিতে বই প্রকাশ- বার কাউন্সিল : সুনির্দিষ্ট একটি দল বা গোষ্ঠীকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে এবং বিশেষ সুবিধা দিতে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নির্বাচনের আগে বই প্রকাশ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বার কাউন্সিলের সদস্য মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান বাদল, মো. কবির উদ্দিন ভূঁইয়া, পারভেজ আলম খান এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সচিব তৌফিকুল ইসলাম।  ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি যতই জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে, ততই চমক সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সর্বশেষ যেটা দেখলাম সেটা হলো আমাদের সাবেক প্রধান বিচারপতির একটি বই নিয়ে। এমন একটা সময় তিনি বইটা লিখেছেন, যার কয়েক দিন আগে ড. কামাল হোসেন একটি মতবিনিময় সভায় বলেন, অল্প দিনের মধ্যেই এস কে সিনহা তথ্য নিয়ে আসছেন। তার মানে তাদের সঙ্গে একটা আগাম যোগাযোগ ছিল যে, একটি বই বের হবে। তার পরেই দেখা গেল বই বেরিয়েছে। সেটি নিয়ে ছুটির দিনেও (গত ২১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার) আইনজীবী সমিতির (বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী) একটি প্রেস ব্রিফিং হয়েছে।’ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘সিনহাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে এবং সে সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন না বলে প্রকাশিত বইয়ে যে তথ্য এসেছে, তা অসত্য, বানোয়াট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’

সর্বশেষ খবর