সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক

সম্পাদক পরিষদের আপত্তির বিষয়টি তোলা হবে মন্ত্রিসভায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা নিয়ে সম্পাদক পরিষদের আপত্তির বিষয়টি মন্ত্রিসভায় আলোচনার জন্য তোলা হবে। আগামী ৩ তারিখ অথবা পরবর্তী মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। মন্ত্রিসভায় আলোচনার পর আবারও সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা। গতকাল সচিবালয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তথ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সম্পাদক পরিষদ এ বৈঠকে বসে। বৈঠকের পর আইনমন্ত্রী বৈঠকে গৃহীত এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এবং দায়িতপ্রাপ্ত তথ্য সচিব আবুয়াল হোসেনও সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন। জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ সদ্য পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ধারা সংশোধনের দাবিতে ২৯ সেপ্টেম্বর শনিবার মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করে। এরপর সরকারের পক্ষে তথ্যমন্ত্রী সম্পাদকদের মানববন্ধন কর্মসূচি স্থগিত করে বৈঠকে বসার অনুরোধ জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতেই গতকাল সচিবালয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠক করেন সরকারের তিন মন্ত্রী ও সম্পাদক পরিষদ। আনিসুল হক বলেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে এ রকম একটা আইন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। আমরা সেই ঐকমত্যে পৌঁছেছি। কিন্তু এ রকম একটা আইন যেন সাংবাদিকতার স্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতা ক্ষুণ্ন না করে সে ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অন্যান্য ধারা নিয়ে কারও বক্তব্য নেই।

তিনি বলেন, ‘৩ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে অনেক এজেন্ডা আছে। হয়তো সেখানে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হবে না। এর পরে যে মন্ত্রিসভার বৈঠক হবে, সেখানে এটা আমি উপস্থাপন করব। এডিটরস কাউন্সিলের যে আপত্তিগুলো তা তুলে ধরব। আলোচনা করার জন্য যে টার্মস অব রেফারেন্স দেওয়া হবে, সে অনুসারে আমরা আবার আলোচনায় বসার জন্য সম্মত হয়েছি।’ আইনমন্ত্রী বলেন, ‘খবরের কাগজে সম্পাদক পরিষদের আপত্তিগুলো প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের বক্তব্য তথ্যমন্ত্রী এবং আইসিটি মন্ত্রীসহ আমরা মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করব। ২১ ধারাটা মোটামুটি আমরা অ্যাগ্রি করেছি যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। কিছু যদি আরও ভালো করা যায় চিন্তা করা হবে।’ সম্পাদক পরিষদের পক্ষে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ আনাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আলোচনার এ উদ্যোগকে সম্পাদক পরিষদ সাধুবাদ জানায়। সম্পাদক পরিষদ মনে করে, যে আইনটি সংসদে পাস হয়েছে তা সংবিধানে বাক ও গণমাধ্যমের যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, তা লঙ্ঘন করবে। এটি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও গণতন্ত্রেরও পরিপন্থী। ওনারা (মন্ত্রীরা) আশ্বাস দিয়েছেন, আলোচনা করে সমঝোতায় আসতে পারবেন।’

এর আগে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সাংবাদিকদের বলেন, ‘আইনটির বিষয়ে সম্পাদক পরিষদ যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কার কথা জানিয়েছে, সেই উদ্বেগের বিষয়ে আমরা শ্রদ্ধাশীল। তাদের দেওয়া আপত্তিগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি, লিপিবদ্ধ করেছি। তবে আপত্তিগুলো আরও পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য তাদের সঙ্গে আরও কয়েকবার বৈঠক করতে হতে পারে।’ বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমেই নিষ্পত্তি করতে পারবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। তথ্যমন্ত্রী বলেন, সরকার মনে করে গণমাধ্যমের কর্মীদের নিরাপদ রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আইনটি সংসদে পাস হয়েছে। তবে রাষ্ট্রপতির দরবারে এটি এখনো যায়নি। রাষ্ট্রপতির সই না হওয়ায় আইনটি এখনো কার্যকর নয়। তবে দেশে ডিজিটাল অপরাধ বেড়ে গেছে। এসব এখন আপদ, বিপদ ও উৎপাতে পরিণত হয়েছে। এর থেকে রক্ষা পেতেই এ আইন করা হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা রক্ষায় সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি বলেন, সম্পাদক পরিষদ এ আইন নিয়ে যে উদ্বেগ ও আশঙ্কা জানিয়েছে, তা দূর করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার। বৈঠকে সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের নেতৃত্বে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, প্রথম আলোর মতিউর রহমান, নিউএজের নুরুল কবীর, মানবজমিনের মতিউর রহমান চৌধুরী, ইনকিলাবের এ এম এম বাহাউদ্দীন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের নঈম নিজাম, যুগান্তরের সাইফুল আলম, কালের কণ্ঠের ইমদাদুল হক মিলন, ঢাকা ট্রিবিউনের জাফর সোবহান, ইনডিপেনডেন্টের শামসুর রহমান, বণিক বার্তার দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, সমকালের মুস্তাফিজ শফিসহ আরও কয়েকজন সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন।

বিএফইউজে, ডিইউজে ও ডিআরইউ নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক : সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে বৈঠকের পর একই বিষয়ে সরকারের তিন মন্ত্রী বৈঠক করেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) এবং রিপোর্টারদের সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নেতাদের সঙ্গে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএফইউজে সভাপতি মোল্লা জালাল, মহাসচিব শাবান মাহমুদ, ডিইউজের সভাপতি আবু জাফর সূর্য, মহাসচিব সোহেল হায়দার চৌধুরী এবং ডিআরইউ সভাপতি সাইফুল ইসলাম, যুগ্ম-সম্পাদক মঈন উদ্দিন খান ও অর্থ সম্পাদক মানিক মুনতাসির। প্রসঙ্গত, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকেই ওই আইনের বিভিন্ন ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিল সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। কিন্তু তাদের আপত্তি আমলে না নিয়েই ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে আইনটি পাস করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে ‘বাকস্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতার পরিপন্থী’ আইন প্রণয়নের প্রতিবাদে ২৯ সেপ্টেম্বর মানববন্ধনের কর্মসূচি দেয় সম্পাদক পরিষদ। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজপথের কর্মসূচিতে না নামার অনুরোধ জানিয়ে সম্পাদক পরিষদকে চিঠি দেন তথ্যমন্ত্রী।

৪০ শিক্ষকের বিবৃতি : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিবর্তনমূলক ধারা বাতিলসহ তিন দফা দাবি জানিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও মিডিয়া স্টাডিজের ৪০ জন শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এই দাবি জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে উল্লিখিত তিন দফা দাবি হলো—আইনের বিতর্কিত ও নিবর্তনমূলক ধারাগুলোকে (যেমন ২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২, ৪৩) রদ করা, অবশিষ্ট প্রত্যেকটি ধারাকে জামিনযোগ্য করা ও শাস্তির মাত্রা কমানো এবং পরোয়ানা ছাড়া পুলিশের অবাধ গ্রেফতার, তল্লাশি ও জব্দ করার ক্ষমতা প্রত্যাহার করা। বিবৃতিতে বলা হয়, ৫৭ ধারা এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন ধারায় সম্প্রতি সংসদে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ঠাঁই নিয়েছে। এ আইন মানুষের সাংবিধানিক অধিকার তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে। এ আইন স্বাধীন সাংবাদিকতার পথকে রুদ্ধ করে দেবে। এ আইন ব্যাপক আকারে মানুষকে হয়রানি করার পথ উন্মুক্ত করে দেবে। বিবৃতিতে ঢাবি সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল মামুন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক আল রাজি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক উজ্জ্বল মণ্ডল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক রাইসুল ইসলামসহ ৪০ জন শিক্ষক স্বাক্ষর করেছেন।

সর্বশেষ খবর