বুধবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ফাঁদ পেতেছে হ্যাকাররা

বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সতর্কবার্তা

মানিক মুনতাসির

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্ভার হ্যাক করতে ফাঁদ পেতেছে হ্যাকাররা। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্য মতে, প্রতিদিন এসব হ্যাকার কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্ভারে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। এমনকি দেশের বাইরে থেকেও তারা বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইট ও সার্ভারের তথ্য চুরির চেষ্টা করছে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আর্থিক খাত সাইবার ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ২৮ শতাংশ ব্যাংকের সাইবার ঝুঁকি  মোকাবিলা করার মতো প্রস্তুতি নেই। সংস্থাটি গত রবিবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ব্যাংকিং খাতে যে কোনো সময় বড় ধরনের সাইবার অ্যাটাক (হামলা) হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যেসব সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয় তার বেশিরভাগই দুর্বল। এমনকি একই সফটওয়্যার দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার হওয়ায় হ্যাকাররা খুব সহজেই সফটওয়্যারের বিকল্প ব্যবহার রপ্ত করে ফেলছে। ফলে খুব সহজেই তারা যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্ভার হ্যাক করতে সক্ষম হয় বলে জানা গেছে। গত ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক করে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমে গচ্ছিত থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার হাতিয়ে নেয় হ্যাকাররা। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সদস্য দেশগুলোকে সাইবার হামলার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। সংস্থা দুটির পাঠানো এক সতর্কবার্তা পর্যালেচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্ভারে হ্যাকাররা আড়ি পাতার চেষ্টা করছে। তারা ক্ষতিকর ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য-ভাণ্ডার কপি করারও চেষ্টা করে থাকতে পারে বলে বিশ্বব্যাংকের আশঙ্কা। চলতি মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিশ্বব্যাংকের একটি চিঠির সূত্র ধরে এসব তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমান উপদেষ্টা দেবপ্রিয় দেবনাথ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হ্যাকারা ওতপেতে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের মোকাবিলার জন্য আমাদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে। এ জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইবার ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়াতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর এশিয়ার প্যাসিফিক গ্রুপের (এপিজি) একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরের সময় এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্ক করে গেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাইবার নিরাপত্তা জোরদার এবং শক্তিশালী সফটওয়্যার ব্যবহারের ব্যাপারে মনোযোগী হতে বলেছে এপিজি। এ ক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা আর্থিক খাতের অভিভাবক প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করা হয়েছে। সম্ভাব্য সব ধরনের সাইবার আক্রমণ ঠেকাতে তথ্য-প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাইবার ঝুঁকি ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হ্যামিলটন প্লেস স্ট্র্যাটেজিসের চলতি বছর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইবার সন্ত্রাসের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতি বছর ক্ষতি হচ্ছে ৪৫০ বিলিয়ন ডলার। আর গত পাঁচ বছরে সাইবার সন্ত্রাস বেড়েছে ২০০ গুণ যা অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এ ধরনের হামলা ঠেকাতে আর্থিক খাতের তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে হ্যামিলটন প্লেস স্ট্যাটেজিস। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কার্যালয়ে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকনোমিস্ট জাহিদ হোসেন বলেন, আর্থিক খাতে সাইবার সন্ত্রাস নিঃসন্দেহে বেড়েছে। এ জন্য সবার সতেচন হওয়া প্রয়োজন। এ থেকে বাঁচতে হ্যাকার বা সাইবার সন্ত্রাসীদের প্রবেশের সম্ভাব্য পথগুলোকে চিহ্নিত করে তা বন্ধ করতে হবে।

গত রবিবার বিআইবিএম প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বব্যাপী দিন দিন বাড়ছে আইটি ঝুঁকি। হ্যাকাররা সব সময় সাইবার হামলার জন্য প্রস্তুত। এরপরও বড় সাইবার হামলা মোকাবিলায় দেশের ২৮ শতাংশ ব্যাংকের প্রস্তুতি নেই। ফলে যে কোনো সময় এসব ব্যাংকে হতে পারে বড় ধরনের সাইবার হামলা। ‘আইটি সিকিউরিটি অব ব্যাংকস ইন বাংলাদেশ : থ্রেটস অ্যান্ড প্রিপেয়ার্ডনেস’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের মাত্র ৩৪ শতাংশ ব্যাংকের সাইবার হামলা মোকাবিলার জন্য আংশিক প্রস্তুতি রয়েছে। আর যে কোনো ধরনের সাইবার হামলা মোকাবিলায় প্রস্তুতি রয়েছে ৩৮ শতাংশ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, বিশ্বব্যাপী দিন দিন আইটি ঝুঁকি বাড়ছে। ব্যাংকিং খাতও এর বাইরে নেই। এ খাতের ওপর যেসব আক্রমণ হচ্ছে, তা জটিল। বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে আলাদা গাইড লাইন তৈরি করেছে। এগুলো সঠিকভাবে পালন করলে ঝুঁকি কমবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর