বৃহস্পতিবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল অনুমোদন

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছে মন্ত্রিসভা। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে কোটা পদ্ধতি বাতিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর ফলে এখন থেকে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে শতভাগ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। আর কোনো কোটা থাকবে না। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সচিবালয়ে নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। অবশ্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে শতভাগ কোটা বাতিল নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সীমিত আকারে হলেও কোটা রাখার পক্ষে মত দেন মন্ত্রিসভার একাধিক সিনিয়র সদস্য। ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা রাখার বিষয়ে আইনের ব্যাখ্যাও তুলে ধরেন মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কার/বাতিলে’ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রস্তাব উত্থাপন করে। সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে সচিব কমিটি যে সুপারিশ করেছিল, তার ভিত্তিতে ওই প্রস্তাবনা উত্থাপন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রিসভাও এ প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে। মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, কোটা সংস্কারে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির রিপোর্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। এতে তিনটি সুপারিশ ছিল। এগুলো হচ্ছে— প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, কোটা বাতিল এবং কোটা বাতিলের ফলে বিদ্যমান জনগোষ্ঠীর বিষয়ে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। তিনি বলেন, মন্ত্রিসভা সচিব কমিটির তিনটি সুপারিশই অনুমোদন দিয়েছে। তবে যদি কখনো অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য কোটার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তবে সরকার তা করতে পারবে। তিনি জানান, আজ-কালের মধ্যে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে। এরপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করবে। আশা করছি দুই-তিন দিনের মধ্যে প্রজ্ঞাপন হয়ে যাবে। তিনি জানান, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্ষেত্রে কোটা বাতিল হলেও তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণিতে কোটা বহাল আছে। প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরির নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে কোনো কোটা না রেখে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের প্রস্তাব দিয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কোটা পর্যালোচনা সংক্রান্ত কমিটি। এর আগে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে কয়েক মাস আন্দোলন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। তাদের আন্দোলনের একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১১ এপ্রিল সংসদে বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতিই আর রাখা হবে না। তবে পরে সংসদে তিনি বলেন, কোটা পদ্ধতি থাকবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ রাখতে হাই কোর্টের রায় আছে। এরপর গত ২ জুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে একটি কমিটি করে সরকার। গত ১৩ অগাস্ট মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের বলেন, তারা সরকারি চাকরির কোটা ‘যতটা সম্ভব’ তুলে দিয়ে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সুপারিশ করবেন। আর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটার বিষয়ে যেহেতু আদালতের রায় আছে, সেহেতু এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়া হবে। এরপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মতামত চাওয়া হলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার মতামত সরকারকে জানান। প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরিতে নিয়োগে এতদিন ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ।

কিছু কোটা রাখার পক্ষে বললেন মন্ত্রীরা : এদিকে মন্ত্রিসভা বৈঠকে কোটা বাতিলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হলে প্রথমেই সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন শতভাগ কোটা বাতিলের বিপক্ষে তার বক্তব্য তুলে ধরেন। এ সময় তিনি বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে শতভাগ কোটা বাতিলের যে সুপারিশ কমিটি করেছে তাতে গলদ আছে। কারণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন-২০১৩ এর দশম তফসিলে প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্ধারিত বয়স শিথিল এবং কোটা সংরক্ষণের বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। শতভাগ কোটা বাতিলের বিষয়ে কমিটির সুপারিশ পুরোপুরি বিপরীত। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ২০১২ সালের মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার প্রস্তাবও অনুমোদন করা হয়েছিল। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে আইনে যেভাবে বলা আছে সেভাবেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য অন্তত ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করার প্রস্তাব রাখেন। তিনি বলেন, আগামী ২০ বছর পর্যন্ত এটি সংরক্ষণ করার পর পুরোপুরি উঠিয়ে দেওয়া হোক। বৈঠক সূত্র জানায়, জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন— না, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোনো কোটা রাখা হবে না। আর ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানও করব না। এ ছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি নারীদের কোটা সংরক্ষণের দাবি জানান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মেয়েরা রাত জেগে আন্দোলন করেছে কোটা বাতিলের জন্য। তারা আর কোটা চায় না বলেও দাবি করেছে। তাই নারীদের জন্য আলাদা কোটা রাখার প্রয়োজন নেই। একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য কোটা রাখার দাবি জানান বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। এদিকে গতকালের বৈঠকে কোটা বাতিল ছাড়াও কাস্টমস আইন-২০১৮ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এর বাইরে স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮ এবং জাতীয় পরিবেশ নীতি-২০১৮ এর খসড়াও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এ ছাড়া বৈঠকের শুরুতে জাতিসংঘ ৭৩ অধিবেশনে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুটি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করায় মন্ত্রিসভা প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এর বাইরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র ওসমান গনির মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করে মন্ত্রিসভা।

সর্বশেষ খবর