রবিবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
মনোনয়নে মাঠের কোন্দল দুই দলে

কেন্দ্রের হুঁশিয়ারি তবু মারামারি

নিজস্ব প্রতিবেদক

কেন্দ্রের হুঁশিয়ারি তবু মারামারি

অসুস্থ মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় বিএনপির অপশাসন ভুলে, সরকারের উন্নয়ন তুলে না ধরে কেউ দলের এমপি-নেতার সমালোচনা করলে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হুঁশিয়ারি আছে। কিন্তু তবুও থামছে না তৃণমূলে মারামারি, দলাদলি আর একে অন্যের চরিত্র হনন। থামানো যাচ্ছে না নৌকা প্রত্যাশীদের বিভক্তি। বিএনপি-জামায়াত নয়, বরং নিজ দলই যেন প্রতিপক্ষ। কোথাও কোথাও একে অন্যকে ঘায়েল করার প্রতিযোগিতা গড়াচ্ছে সংঘর্ষে, ঘটছে প্রাণহানি। এই ‘অসুস্থ’ প্রতিযোগিতা বন্ধ না হলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের জন্য আওয়ামী লীগই যথেষ্ট বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দলের অভ্যন্তরীণ সহিংসতা আশঙ্কাজনক বাড়ছে। আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন একটি দল ক্ষমতায় থাকলে সেই দলের সাংগঠনিক তৎপরতা কমে যায়। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যবসা-বাণিজ্য পাওয়া না পাওয়ার ব্যাপারে কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। ড. মীজান বলেন, অনেক এমপি আছেন, এলাকা লিজ দিয়েছেন। তিনি ঢাকায় থাকবেন, শ্বশুরবাড়ির লোকজন এলাকা চালাবে। ফলে আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা বঞ্চিত হয়েছে। আবার মনোনয়ন প্রতিযোগিতা তো রয়েছেই। ফলে নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। এভাবেই অভ্যন্তরীণ খুনোখুনি বা সহিংসতা বাড়ছে। এসব বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, মানুষ উপকারের চেয়ে অপকার মনে রাখে। কারা এমপি-নেতা-কর্মীর কাছে লাঞ্ছিত হয়েছে, সেগুলো সমাধান করতে হবে। উন্নয়ন মেলা করে লাভ নেই, এগুলো না করেই মানুষ দেখতে পারছে যে কেমন উন্নয়ন হয়েছে। আগে যারা নিজ দলের এমপি-নেতার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের কীভাবে পুষিয়ে দেওয়া যায় সে ব্যবস্থা আওয়ামী লীগকে করতে হবে। 

গত সোমবার বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ দুজন নিহত হয়েছেন। স্থানীয় তথ্য মতে, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনসার আলী আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-৪ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগের সমর্থক। আর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অভিযুক্ত স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শহীদুল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য ডা. মোজাম্মেল হোসেনের সমর্থক। ওই দুই নেতার নামাজে জানাজায় ডা. মোজাম্মেল কথা বলার চেষ্টা করলে তার দিকে জুতা-স্যান্ডেল নিক্ষেপ করা হয়। বর্তমানে এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

গত শুক্রবার ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কৃষক লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুজন নিহত হন। তারা দুই মনোনয়ন প্রত্যাশীর সমর্থক বলে জানা গেছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর বরিশালের উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও একই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালদার নান্টুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে উত্তেজিত জনতা স্থানীয় সংসদ সদস্য তালুকদার মো. ইউনুসের সমর্থক এক নেতার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে অনেক আগে থেকেই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল চলছিল। নিহত বিশ্বজিৎ হালদার নান্টু উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান ইকবালের অনুসারী ছিলেন। হাফিজুর রহমান ইকবাল এবার নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী।  

নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের এমপি গাজী গোলাম দস্তগীরের বিরুদ্ধে নেতা-কর্মীদের বিস্তর অভিযোগ। এমপির অনুসারী না হওয়ায় নিজ দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দুই হাজার ৫শ মামলা দিয়েছেন বলে অভিযোগ উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের। এ ছাড়া সেখানে বিভিন্ন সময় সংঘর্ষে কয়েকজন নিহত হয়েছেন। এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। 

নোয়াখালীর হাতিয়ায় আধিপত্য বিস্তার ও সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে চলছে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস, তার স্বামী মোহাম্মদ আলী, জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম আমির ও  উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শিল্পপতি মাহমুদ আলী রাতুল মনোনয়ন প্রত্যাশী। এই মনোনয়নকে কেন্দ্র করে সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস ও তার স্বামী মোহাম্মদ আলীর গ্রুপের সঙ্গে আমির ও মাহমুদ আলী রাতুল গ্রুপের প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ হচ্ছে। গত দুই বছরে সেখানে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ১১ জন নিহত হয়েছেন।

গত ২১ জুলাই চাঁদপুরের মতলব (উত্তর) উপজেলার সুলতানাবাদ ইউনিয়নের চরপাথালিয়ায় কেন্দ্রীয় কৃষকলীগের কোষাধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম খোকা পাটওয়ারী ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সমর্থকদের মাঝে সংঘর্ষ হয়েছে। আমিনুল ইসলাম এবার ওই আসন থেকে নৌকার মনোনয়ন চান। কুমিল্লা-১ আসনের মনোনয়ন নিয়ে চলছে নৌকা প্রত্যাশীদের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই। এ আসনের এমপি মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভুইয়া। এখানে মনোনয়ন চান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আবদুস সবুর ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সেলিনা ইসলাম সিআইপি। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রোড শো কর্মসূচি বিপুল সংখ্যক লোক নিয়ে উপস্থিত হওয়ায় সেলিনা ইসলামের নেতা-কর্মীদের মারধর করা হয় বলে তার অভিযোগ আছে।

নেত্রকোনা-৫ আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল। এ আসনে নৌকার মনোনয়ন চান দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। এলাকায় নিজ আধিপত্য ধরে রাখতে ব্যস্ত দুই নেতা। তাদের কর্মীরাও পৃথকভাবে চলেন। গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় পূর্বধলায় আহমদ হোসেন ও ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে পুলিশ, সাংবাদিকসহ ২০ জন আহত হন।  

নির্বাচনী মনোনয়ন নিয়ে নীলফামারী-৩ আসনে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি পালন নিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশী আবদুল ওয়াহেদ বাহাদুর স্থানীয় এমপি গোলাম মোস্তফাকে লাঞ্ছিত করেন। প্রতিবাদে এমপি রাত ১টা পর্যন্ত রাস্তা অবরোধ করে রাখেন। 

পটুয়াখালী-১ আসনে এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন। আরেক গ্রুপে রয়েছেন সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়া এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ হাওলাদার। রংপুর-৫ আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমানের বিরুদ্ধে এলাকায় বলয় সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। তার ছেলে রাশেক রহমান ‘একান্ত লীগ’ গঠন করে দলীয় নেতা-কর্মীদের দূরে সরিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ মিঠাপুকুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের।  জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগে দীর্ঘদিন ধরে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে দলটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের দ্বন্দ্ব। শেরপুর-২ আসনের বর্তমান এমপি ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বাদশার।

ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। গত সংসদ নির্বাচনে নৌকার বিপরীতে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী জাফরউল্যাহকে পরাজিত করেন তিনি। তারা দুজনই এবার নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী। এ দুজনই নির্বাচনী এলাকায় পৃথক কর্মসূচি পালন করেন। তাদের দুই গ্রুপের নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রায়ই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের এমপি আলী আজগর টগর ও অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হাশেম রেজার মধ্যে সম্পর্ক ভালো নেই। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এমপি টগরের আপন দুই ভাই মাদক ব্যবসায় জড়িত বলে অভিযোগ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি গোপন প্রতিবেদনে তাদের নাম আসার পর দুজন গা ঢাকা দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের সঙ্গে জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামছুল আলম দুদুর দ্বন্দ্ব আছে। সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব কেন্দ্রীয় সদস্য ইকবাল হোসেন অপুর। সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মিজবাহ উদ্দিন সিরাজের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের মনোনয়ন নিয়ে বিরোধ রয়েছে। 

কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি আবদুর রউফ। তিনি এবারও মনোনয়ন চান। এ আসনে মনোনয়ন পেতে জোর লবিং করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সদর উদ্দিন খান, সাবেক এমপি সুলতানা তরুণ, খোকসা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বিটু। এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধ আছে। 

দলের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যদি কোনো জায়গায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা তো দলীয়ভাবে কাউকে কোন্দল বা সহিংসতা করতে বলিনি। তিনি বলেন, প্রতিটি আসনে আমাদের দলের ১০-১৫ জন যোগ্য প্রার্থী রয়েছেন। কারণ আমরা নেতা তৈরি করি। সে কারণে তাদের ভিতরে প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। আমাদের প্রতিযোগিতায় বিএনপি-জামায়াত সুযোগ নিচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। আর আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক পরিষ্কারভাবে বলেছেন, যারাই মনোনয়ন প্রতিযোগিতা নিয়ে বিশৃঙ্খলা করবেন তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না। কাজেই যারা বিরোধে জড়াবে, সহিংসতা করবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

সর্বশেষ খবর