রবিবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাজনীতি এখন গরিবের ভাবী হয়ে গেছে

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

রাজনীতি এখন গরিবের ভাবী হয়ে গেছে

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ

রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘রাজনীতি এখন গরিবের ভাউজ (ভাবী) হয়ে গেছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা থেকে শুরু করে সবাই এখন অবসরের পর রাজনীতি করতে চায়। সরকারি ও বিরোধী দলকে এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত এই সমাবর্তনে সমাবর্তন বক্তা ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। এতে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ ও ইনস্টিটিউটের ডিন ও পরিচালক, সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্যবৃন্দ।

সমাবর্তন উপলক্ষে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। সকাল থেকেই সমাবর্তনস্থলে গ্র্যাজুয়েটরা আসতে শুরু করেন। কেউ কেউ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে দল বেঁধে ছবি তোলেন। আবার কেউ কেউ ব্যস্ত ছিলেন সহপাঠীদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাবর্তন অভিমুখে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অতিথিরাও আসতে শুরু করেন। বেলা ১২টার দিকে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আবদুল হামিদের নেতৃত্বে শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। শোভাযাত্রা শেষে রাষ্ট্রপতি অতিথিদের নিয়ে মঞ্চে আগমন করেন। এরপর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। সবাই দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। ১২টা ৫ মিনিটে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত ও নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা স্বাগত সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করেন। সাংস্কৃতিক পরিবেশনা শেষে বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও কোষাধ্যক্ষ পিএইচডি, এমফিল, স্নাতক ও স্নাতকোত্তার ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের নাম রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের কাছে উপস্থাপন করেন। রাষ্ট্রপতি ৮১ জনকে পিএইচডি, ২৭ জনকে এমফিল এবং ২১ হাজার ১১১ জন গ্র্যাজুয়েটকে ডিগ্রি প্রদান করেন। পরে তিনি কৃতী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ৯৬টি স্বর্ণপদক প্রদান করেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের গ্রামে একটা প্রবাদ আছে, গরিবের বউ নাকি সবার ভাউজ (ভাবী)। এখন রাজনীতি সাবজেক্টটা হয়ে গেছে গরিবের ভাউজের মতো। এখানে যে কেউ যে কোনো সময় ঢুকে পড়তে পারে। আমি যদি বলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের প্রফেসর হতে চাই, ভিসি স্যার ঢোকাবেন না। বা আমি যদি কোনো হাসপাতালে গিয়ে বলি, এত বছর রাজনীতি করেছি, আমাকে ডাক্তারির জন্য দেওয়া হোক। বোঝেন অবস্থাটা কী হবে। ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি পড়াতে যাব এ কথা বললে হাসির পাত্র হওয়া ছাড়া কিছুই হবে না। কিন্তু রাজনীতি গরিবের ভাউজ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সবাই করে। ৬৭ বছর সরকারি চাকরি করে অবসরের পরে বলে আমিও রাজনীতি করব। আমার মনে হয় সব রাজনৈতিক দলকে এটা চিন্তা করা উচিত। সরকারি ও বিরোধী দলগুলোকে বলছি, এই জিনিসগুলো আপনারা চিন্তা করেন। যারা ছোটবেলা থেকে রাজনীতি করে আসছে শুধু তারাই থাকুক। ডাইরেক্ট কেউ রাজনীতিতে এসে মন্ত্রী হয়ে যাবে এটা যেন কেমন কেমন লাগে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু ইলেকশন হয়ে গেলে পর্যায়ক্রমে সব জায়গায় নির্বাচন হয়ে যাবে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘ছাত্রসমাজ নেতৃত্ব নিলে রাজনীতিতে ঢুকে পড়া বাধাগ্রস্ত হবে। আগে তো তা-ই ছিল। এখন যে কোত্থেকে কে এসে নেতা হয়ে যায় আল্লাহ মালুম। মনে হয় উড়ে এসে জুড়ে বসে। এটা থামা দরকার।’ ডাকসুর বিষয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘ডাকসুর ইলেকশন নিয়ে একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। তবে আমি এই ব্যাপারে ছাত্রসমাজের কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ জানাই, নির্বাচনের তফসিল হলে অনেক ধরনের ক্যালকুলেশন হবে। অনেকে ভেজাল সৃষ্টি করে দিতে পারে। অনেকে অনেক স্বার্থে এটা করতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি ঢাকা ভার্সিটির সমস্ত ছেলে-মেয়েকে বঞ্চিত করা আপনাদের ঠিক হবে না।’ এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি সবাইকে তৎপর থাকার জন্য বলেন, যাতে কেউ এ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে। ষাটের দশকের ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে বর্তমান ছাত্ররাজনীতির বিস্তর ফারাক উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সে সময়ের ছাত্ররাজনীতি ছিল আদর্শভিত্তিক। সেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ ছিল না। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। সেই আদর্শকে ধারণ করে ১৯৭১ সালে জাতির পিতার নেতৃত্বে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। এখন আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক। স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ হয়েছে কিন্তু দেশ গড়ার সংগ্রাম শেষ হয়নি। সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার যে প্রত্যয় ছিল তা আজও পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হয়নি। তাই দেশ গড়ার কাজে নবীন গ্র্যাজুয়েটদের নেতৃত্ব দিতে হবে। জাতির পিতার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।’ গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘নিছক চাকরির জন্য উচ্চশিক্ষা নয়। উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য হলো নিজে শিক্ষিত হওয়া এবং অন্যকে শিক্ষিত করা; মানবিকবোধ জাগ্রত করা, জীবনকে প্রকৃত অর্থে উপলব্ধি করা; মানবসত্তা দিয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করা। উচ্চশিক্ষা নিয়ে সবাই যে প্রতিষ্ঠিত হবে, বিত্ত-বৈভবের মালিক হবে এমনটা নয়। মনুষ্যত্ব বিকাশই হলো উচ্চশিক্ষার মূল লক্ষ্য। সেই অর্জনে আমরা কতটুকু এগোতে পেরেছি তা বিবেচ্য বিষয়। একটি সুষ্ঠু ও মেধাভিত্তিক সমাজ গঠন করতে হলে বিত্তের পরিবর্তে চিত্তের প্রসারকে গুরুত্ব দিতে হবে। না হলে অশুভ অনৈতিক প্রতিযোগিতা সমাজকে রুদ্ধ করে দেবে, মনুষ্যত্বের বিকাশ হবে সুদূরপরাহত।’ জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘আমি খুব জোর দেব শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের বিকাশে। উচ্চশিক্ষা লাভ করে শিক্ষার্থীরা যদি ভালো-মন্দ বিচার করতে না পারে এবং ভালোর পক্ষে দাঁড়িয়ে মন্দকে প্রতিরোধ করতে না পারে, তাহলে তাদের উচ্চশিক্ষা বৃথা। জীবনে আহরিত মূল্যবোধ সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ না-ও হতে পারে। শিক্ষার্থীরা যদি মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া মূল্যবোধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সর্বাগ্রে আমি তাকেই স্বাগত জানাব।’

সর্বশেষ খবর