সোমবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সাড়াশব্দহীন জঙ্গিদের নিয়ে আতঙ্ক

সাখাওয়াত কাওসার

বেশ কিছু দিন ধরেই সাড়া নেই জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের। তবে আত্মগোপনে থেকে জঙ্গিরা চুপিসারেই চালাচ্ছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্বেগের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে গোয়েন্দাদের। আর জঙ্গিদের এই চুপচাপ থাকা অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে র‌্যাব-পুলিশসহ সব সংস্থার মনে। কিছু দিন আগে এ বিষয়টি নিয়ে পুলিশ সদর দফতর থেকে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নির্বাচনকালীন জঙ্গিরা তাদের অবস্থান জানান দিতে পারে। সর্বশেষ গত শুক্রবার চট্টগ্রামের মীরেরসরাইয়ে একটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান গোয়েন্দাদের ভাবনায় নতুন দুঃশ্চিন্তা যুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি সারা দেশে জঙ্গিদের রাসায়নিক হামলার আশঙ্কায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

গত এক মাসে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা ও থানা এলাকা থেকে দেড় শতাধিক জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একাধিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকরা দেশে অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে। আগামী তিন মাসে দেশ যখন পুরোপুরি নির্বাচনমুখী হয়ে উঠবে তখন তারা পরিস্থিতি বুঝে ফের নির্বাচনী সমাবেশে হামলা নাশকতা চালানোর প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে। নীরবে হলেও বর্তমানে জেএমবিসহ আরও কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। উগ্র-মৌলবাদে বিশ্বাসী কিছু ইসলামী দল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জঙ্গিদের মাঠপর্যায়ে সহযোগিতা করছে। পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) প্রধান, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই দেখা গেছে নির্বাচনের সময়কে টার্গেট করে ঘটনা ঘটিয়েছে জঙ্গিরা। আমাদের দেশেও হয়তো জঙ্গিরা এ সময়টার সুযোগ নিতে চাইতে পারে। তবে আমরাও বসে নেই। সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে পুলিশসহ অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের গোপন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে আগাম প্রস্তুতি নিতে সারা দেশে বিশেষায়িত মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেলা সদর হাসপাতালগুলোতেও এ বিষয়ে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে। ওই গোপন প্রতিবেদনে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের টার্গেট কিলিংয়ের বিষয়েও সতর্ক থাকতে দেওয়া হয়েছে বিশেষ বার্তা। এ ছাড়া সম্প্রতি ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি গোয়েন্দা সংস্থার জমা দেওয়া প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে জানায়, ‘বাংলাদেশে জেএমবি সদস্যরা একত্রিত হয়ে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে হামলার পরিকল্পনা করেছে। এ জন্য তারা সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে কর্মী সংগ্রহ করছে। তারা অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সুইসাইডাল ভেস্টও কিনছে।’ অপরাধ বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত গোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজনেই জঙ্গি সংগঠনগুলোকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী পরিবেশ বিতর্কিত করার চেষ্টা করতে পারে। জঙ্গিবাদ নিয়ে আশঙ্কা তো অনেক আগে থেকেই রয়েছে। জঙ্গিরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এ নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার কোনো সুযোগ নেই। সূত্র বলছে, ২০০৫ সাল থেকে শায়খ আবদুর রহমানের পরিবারসহ তাদের ঘনিষ্ঠ আরও ২৫টি পরিবার মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। বিশেষ করে শায়খ রহমানের বোনের স্বামী খোরশেদ আলম, আবদুর রাকিব, সাকিব ও নূরসহ অন্যরা দেশে জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে অর্থায়ন করছে। বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে তারা দেশে অর্থ পাঠায়। এদের মধ্যে রাকিব নামে এক জঙ্গি কয়েক মাস আগে দেশে এসেছিল। তার ঘনিষ্ঠ জঙ্গিদের সঙ্গে দেখা করে সে আবার বিদেশে ফিরে গেছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ধরে কাজ করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সম্প্রতি ফেনী থেকে আবদুল্লাহ আল মঞ্জু ওরফে জাহাঙ্গীর নামে এক জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তার সঙ্গে বিদেশে পলাতক জঙ্গিদের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি নেতাদের অর্থায়নে। হুজির ৬০টি পরিবার রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুরসহ সাতক্ষীরায় সক্রিয় রয়েছে। তারা ওইসব অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। পাশাপাশি হুজির নেতৃত্বে জঙ্গিদের নতুন জোট ‘বাংলাদেশ জিহাদি গ্রুপ’-কে দীর্ঘদিন ধরে গোপনে মোটা অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী। ঢাকার বিদেশি একটি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও জঙ্গিদের যোগাযোগ থাকার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এর আগে ঢাকা ও ঢাকার উপকণ্ঠ নারায়ণগঞ্জ থেকে হুজির চার জঙ্গি রফিক আহমেদ ওরফে সাজিদ, ওমর ওরফে ফয়জুল রবি, নাদিম আহমেদ ও সালাউদ্দিন নামে চার জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে গোয়েন্দা পুলিশ হুজির মাঠপর্যায়ের তৎপরতা সম্পর্কে তথ্য পায়। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের তথ্য ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাকাত, কোরবানির পশুর চামড়া, উশর (শস্যের জাকাত) থেকেও দীর্ঘদিন ধরে অর্থ সংগ্রহ করছে জঙ্গিরা। বিশেষ করে জেএমবির জাল টাকা ও ডাকাতির অর্থের পাশাপাশি পরিবহন ব্যবসা এমনকি ইটের ভাটায় বিনিয়োগ করা অর্থও সংগঠনের কাজে লাগাচ্ছে। জেএমবি ছাড়াও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়া নব্য জেএমবির তহবিলের প্রধান অর্থদাতা বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। সম্প্রতি রংপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিরা জানিয়েছে, নির্বাচনের সময় তারা ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয় অর্থাৎ কাটআউট পদ্ধতিতে ভিন্ন নেতার নির্দেশে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীরও মাঝে মাঝেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সেঁটে তাদের অবস্থানের বিষয়টি জানান দিচ্ছে। গত ৩ অক্টোবর মেহেরপুর জেলার ফৌজদারি পাড়ায় অভিযান চালিয়ে ‘আল্লাহর দল’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের চার সদস্যকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তারা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের ঘনিষ্ঠ আরও ৪০ জনকে ধরার চেষ্টা চলছে জানিয়ে পুলিশ বলছে, গ্রেফতারকৃতরা জেএমবির অন্যতম নেতা গাইবান্ধার জঙ্গি নেতা মতিন মেহেদীর অনুসারী। মতিন মেহেদী বর্তমানে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে টাঙ্গাইলের জেলা কারা কারাগারে রয়েছেন। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মীরেরসরাইয়ের জঙ্গি আস্তানার উদ্ধারকৃত একটি মানচিত্র থেকে জঙ্গিদের বড় ধরনের টার্গেটের কথা আমরা অনুমান করছি। তবে নির্বাচনের সময় জঙ্গিরা কোনো ধরনের অপতৎপরতার চেষ্টা করলেও র‌্যাব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে তা মোকাবিলা করার। আমরা সব ধরনের আশঙ্কাকেই মাথায় রেখে কাজ করে যাচ্ছি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর