বুধবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার রায় আজ

তারেক-বাবরসহ আসামি ৪৯ ♦ ১৪ বছরের বিচার প্রক্রিয়া ♦ দৃষ্টি থাকবে আদালতে

আরাফাত মুন্না

ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার রায় আজ

২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলায় রোমহর্ষক পরিবেশের সৃষ্টি হয় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে —ফাইল ছবি

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে ১৪ বছর আগে। সেদিন ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেলেও তাঁর দলের ২৪ জন নেতা-কর্মীর প্রাণ যায়। ওই হামলায় দলীয় কর্মী, সাংবাদিক, পুলিশসহ আরও কয়েক শতাধিক মানুষ আহত হয়। ভয়াবহ এ হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে করা দুটি মামলার বিচারকাজ শেষে আজ রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য রয়েছে। রায় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে সব মহলে। রায় কী হবে, এটাই জানতে চায় সবাই। বলা চলে আজ দেশের ১৬ কোটি মানুষেরই  দৃষ্টি থাকবে নাজিমউদ্দিন রোডে পুরাতন কারাগারের পাশে স্থাপিত বিশেষ আদালতের দিকে। হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা দুই মামলায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরসহ আসামি ৪৯ জন। এর মধ্যে তারেক রহমান, হারিস চৌধুরীসহ পলাতক ১৮ জন। বাবরসহ বাকিরা সবাই কারাগারে রয়েছেন। এ রায়ের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১৪ বছরের প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে বলে মন্তব্য রাষ্ট্রপক্ষের। অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে দাবি করে সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তিও চেয়েছে তারা। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, যদি কোনো ‘ওহি নাজিল’ না হয় তাহলে আসামিরা ন্যায়বিচার পাবেন।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে এক সন্ত্রাসবিরোধী সভায় চালানো হয় এ গ্রেনেড হামলা। শুরু থেকেই নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে নানা চেষ্টা করা হয় বলে বক্তব্য এসেছে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের কাছ থেকে। সাজানো হয়েছিল জজ মিয়া নাটকও। আর একজন বিচারপতির নেতৃত্বে পরিচালিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনও এ হামলার পেছনে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করে প্রতিবেদন দিয়েছিল। তবে সব ‘অপচেষ্টাই’ ভেস্তে গেছে মামলার অধিকতর তদন্তের পর।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে তদন্ত শুরু করে। বেরিয়ে আসে অনেক অজানা তথ্য। ২০০৮ সালের জুনে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই তাজউদ্দিন, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি-বি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। তদন্তে বেরিয়ে আসে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওই হামলা চালানো হয়েছিল। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড এসেছিল পাকিস্তান থেকে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেই এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির বিচার শুরু হয়। ৬১ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এসে এর অধিকতর তদন্ত করে। এরপর বিএনপি নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে নতুন করে আসামি করে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এরপর দুই অভিযোগপত্রের মোট ৫২ আসামির মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হয়। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, যারা জোট সরকার আমলে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতর (ডিজিএফআই) ও র?্যাবের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত ছিলেন। পরে এ মামলার তিন আসামির অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় তাদের এ মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়। গ্রেনেড হামলার দুই মামলার অভিযোগ প্রমাণে অভিযোগপত্রে ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২২৫ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন। তাদের সাক্ষ্যের মধ্য দিয়ে জড়িত সবার বিষয়ে তথ্য এসেছে বলে জানায় রাষ্ট্রপক্ষ। গত বছরের ৩০ মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহ্হার আকন্দের জেরা শেষের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। ১১৯ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়। এতে রাষ্ট্রপক্ষ নিয়েছে ২৯ কার্যদিবস। বাকি ৯০ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে আসামিপক্ষ। গত ১৮ সেপ্টেম্বর উভয় পক্ষের (রাষ্ট্র ও আসামি) যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন আজ ১০ অক্টোবর রায়ের জন্য দিন ঠিক করেন।

রায় নিয়ে নিজের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা ইতিহাসের জঘন্যতম হামলা। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রতিপক্ষ দলের রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা। এ হামলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। দেশকে জঙ্গিরাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আলোচিত হাওয়া ভবনে বসে তারেক রহমান এ হামলায় মদদ দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মদদ দিয়েছে। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র এ হামলার ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। তা আমরা সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রমাণ করতে পেরেছি।’ সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে বলেই আশা প্রকাশ করেন তিনি।

রাষ্ট্রপক্ষের আরেক আইনজীবী আকরাম উদ্দিন শ্যামল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসামিদের অপরাধগুলো সন্দেহের ঊর্ধ্বে থেকে প্রমাণ করতে পেরেছে। এখন শুধু আদালতের রায়ের মাধ্যমে সাজা ঘোষণার সময়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ রায়ের জন্য আমরা যেভাবে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেছি, তাতে সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তিই হবে।’ আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ মামলায় তারেক রহমানসহ বিএনপি নেতাদের ফাঁসানোর চক্রান্ত চলছে। এখানে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই। সব শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে সাক্ষ্য।’ তিনি বলেন, ‘রায়ের বিষয়ে যদি কোনো “ওহি নাজিল” না হয়, তাহলে বিএনপি নেতারা সবাই খালাস পাবেন।’ অন্য আসামিরাও ন্যায়বিচার পাবেন বলে আশা এই আইনজীবীর।

কারাগারে আটক যারা : লুত্ফুজ্জামান বাবর, মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার (অব.), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম (অব.), আবদুস সালাম পিন্টু, মুফতি হান্নানের ভাই মহিবুল্লাহ ওরফে অভি, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে রাজ্জাক, উজ্জ্বল ওরফে হাফেজ আবু তাহের, রফিকুল ইসলাম গাজী, আবুল কালাম আজাদ বুলবুল, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. আবু জাফর, জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ ওরফে তামিম, মুফতি মইনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল ও শাহদাত উল্লাহ জুয়েলসহ ২৩ জন।

এদিকে বিচার চলাকালে জামিনে থাকলেও গত ১৮ সেপ্টেম্বর রায়ের দিন ঠিক করার দিন জামিন বাতিল হওয়ায় সাইফুল ইসলাম ডিউক, কমিশনার আরিফ, আশরাফুল হুদা, খোদা বখশ চৌধুরী, শহুদুল হক, সিআইডির সাবেক এস এস রুহুল আমিন, সাবেক এসএসপি আতিকুর রহমান ও আবদুর রশিদও এখন কারাগারে রয়েছেন।

পলাতকরা কে কোথায় : বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় পলাতক ১৮ আসামি হচ্ছেন—তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, এ টি এম আমিন, লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার (অব.), খান সাঈদ হাসান, ওবায়দুর রহমান, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, রাতুল বাবু, মোহাম্মদ হানিফ, আবদুল মালেক, শওকত হোসেন, মাওলানা তাজউদ্দিন, ইকবাল হোসেন, মাওলানা আবু বকর, খলিলুর রহমান ও জাহাঙ্গীর আলম। এদের কে কোথায় আছেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। তবে এই ১৮ জনের মধ্যে বর্তমানে তিনজনের নামে ইন্টারপোলের রেড নোটিস রয়েছে। তারেক রহমান এবং বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের নামে রেড নোটিস আগে থাকলেও তা সরিয়ে নিয়েছে ইন্টারপোল। বাকিদের বিষয়ে মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডির পক্ষ থেকে কোনো আবেদনই পাঠানো হয়নি ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোতে (এনসিবি)। এ সংস্থা সূত্র জানায়, ধারণা করা হচ্ছে তাজউদ্দিন দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা পাকিস্তানে, হারিছ চৌধুরী মালয়েশিয়া, আমেরিকা অথবা লন্ডনে ঘুরেফিরে অবস্থান করছেন। রাতুল রয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। কায়কোবাদ মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে, হানিফ থাইল্যান্ড অথবা মালয়েশিয়ায়, সাবেক সেনা কর্মকর্তা এ টি এম আমিন যুক্তরাষ্ট্রে ও সাইফুল জোয়ার্দার কানাডায়, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান ও খান সাঈদ হাসান পাকিস্তান অথবা মালয়েশিয়ায়, জঙ্গি আনিসুল মুরসালিন ওরফে মুরসালিন ও মহিবুল মুত্তাকিন ভারতের তিহার কারাগারে রয়েছেন।

সর্বশেষ খবর